অনুশোচনা (দ্বিতীয় খণ্ড)

avatar

292792336_728755871749546_442059767397907062_n.jpg

বিয়ের পর দিন দিন মেয়ের সাথে আমার যোগাযোগও কমে যায়, প্রথমে খারাপ লাগলেও পরে মনে হয় আর যাই হোক মেয়ে তো সুখে আছে। শুধু খারাপ লাগতো যখনই ওদের বাসায় যেতাম মেয়েটার মুখে কখনো হাসি দেখতাম না। যেন আমার মেয়ের মুখের হাসি চিরদিনের জন্য চলে গেছে। জিনিসটা আমার ভেতরে ব্যথা দেওয়া শুরু করে। যদিও আমার মেয়ে আমাকে কিছু বলে না। বলে ও সুখেই আছে। কোন সমস্যা হচ্ছে না। তাও কেন জানি মনে হতো সামথিং ইস রং।

বিয়ের চার বছর পর একদিন রাত তিনটার সময় হঠাৎ করে আদর বাসায় আসে। প্রথমে বিশ্বাসই হয়নি আদর এভাবে কলিং বেল চাচ্ছে। প্রচন্ড ঘুমের চোখে দরজা খুলে রীতিমতো বড় ধরনের একটা ধাক্কা খাই। এটা কি আমার মেয়ে! কি অবস্থা! আমার মেয়ের ঠোঁট দিয়ে রক্ত পড়ছে, নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে, মাথার এক পাশের চুল খাবলে উঠানো হয়েছে, মাথার তালুতে হালকা হালকা রক্ত জমেছে, হাতে লাঠি দিয়ে মারার দাগ। ঠিকমতো জামা কাপড়ও পড়া নেই মেয়েটা। তারপর যা জানলাম তা শোনার জন্য কোন বাবা কখনো প্রস্তুত থাকবে বলে আমার মনে হয় না। জানলাম জিহাদ অনেক আগে থেকেই ছিল নারীর আসক্ত। বিয়ের আগেই তার অনেক ধরনের মেয়েদের সাথে শারীরিক সম্পর্ক ছিল। বিয়েটা ছিল শুধুমাত্র সমাজের চোখে ভালো সাজার নাটক। জিহাদের পরিবার সবই জানতো তারপরও কখনো ছেলেকে শাসন করত না। উল্টো আদর যখন তাদের কিছু বলতো আদর কে কথা শোনাতো। বলতো নিজের হাসবেন্ডকে সুখী রাখতে পারে না। আদর যখন জিহাদকে কিছু বলতে যেত তখন জিহাদ ইচ্ছামত যেভাবে ইচ্ছা যেখানে ইচ্ছা আদরের গায়ে হাত তুলতো। যেহেতু তাদের টাকা পয়সার অভাব নেই এবং যথেষ্ট পাওয়ারও আছে তাই আদর কে সবসময় ভয় দেখানো হতো যেন আমাকে কিছু জানানো না হয়। না হলে আমার ক্ষতি করা হবে। এত বছর ধরে টানা এগুলো সহ্য করে যাচ্ছিল আমার মেয়েটা। কিন্তু আজ নাকি জিহাদ বাসাতেই এক মেয়েকে নিয়ে এসেছে এবং আদর কে মেরে রুম থেকে বের করে দিয়েছে। তাই আমার মেয়ে এক কাপড়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেছে, নিজের জীবনে ঝুঁকি নিয়ে আমার বাড়ির দরজায় রাত তিনটার সময় এসেছে। আমি তখনো ঘরের মধ্যে আছি। মাথায় কাজ করছিল না আহত মেয়ের সেবা করব নাকি ওই জানোয়ারদের শাস্তি দিব। কিন্তু মাথায় বারবার ঘুরছিল আমি নিজেও তো সমান দোষী। যাই হোক কোন রকম ভাবে আদরকে হসপিটালে নিয়ে গেলাম। জানতে পারলাম ওর অবস্থা যা দেখা যাচ্ছিল তার থেকেও করুন। দীর্ঘদিন ধরে মার খেতে খেতে ওর শরীরের অবস্থা এবং মানসিক অবস্থা অনেক খারাপ পর্যায়ে চলে গেছে।

এভাবেই চলতে চলতে একসময় আমরা কেস করলাম কিন্তু সবাই জানতাম আমরা জিতব না এবং ঠিকই জিতিনি। ওরা কোর্টে প্রমাণ করে দেয় সমস্যা আমার মেয়েরই ছিল। আমার মেয়ের মানসিক সমস্যা যার জন্য সে এসব ভুলভাল বকে, আর শরীরের সেই মার গুলো নাকি ও নিজেই নিজেকে দিত। এভাবে তারা পার পেয়ে যায়, অন্যদিকে আমার মেয়ের অবস্থা দিনের পর দিন খারাপের দিকে যায়। এক সময় সে মানসিক রোগী হয়ে যায়।

৮ বছর পর হঠাৎ রায়হান নামে এক লোক আমার বাসায় আসলো। বয়স হওয়ার জন্য এখন অনেককেই চিনতে পারিনা। তাই স্বাভাবিকভাবে উনাকেও চিনতে পারছিলাম না। কে এই রায়হান। তারপর যখন তার পরিচয় জানলাম একটা বড় ধাক্কা খেলাম। এই সেই ছেলে যার সাথে আমার মেয়ের প্রেম ছিল। যাকে আমার মেয়ে পাগলের মতো ভালোবাসতো। জানতে পারলাম ছেলেটাও আমার মেয়েটাকে সত্যি পাগলের মতই ভালবেসেছিল। আজ সে প্রতিষ্ঠিত, নিজের একটা বড় ব্যবসা আছে। বাড়ি আছে, গাড়ি আছে। এখনো বিয়ে করেনি। মাঝে তার দু একটা প্রেম হয়েছে কিন্তু কাউকে মন থেকে মানতে পারেনি। কোনভাবে জানতে পেরেছে আমার মেয়ের ডিভোর্স হয়েছে তাই খোঁজ নিতে এসেছে আমার মেয়ে কেমন আছে। কিন্তু নিয়তির বিধান! এক বছর আগেই আমার মেয়ে আত্মহত্যা করেছে মানসিক কষ্ট সহ্য করতে না পেরে। আমি বাবা হয়ে কিছুই করতে পারিনি শুধু কেঁদেছি। আদরের পরিচিত কারো সাথে আমার যোগাযোগ না থাকায় বা পরিচিতি না থাকায় কেউই জানে না আসলে আদরের মৃত্যুর খবরটা। তাই রায়হানও জানত না যে আদর এক বছর আগেই মারা গেছে। সেই আট বছর আগে যেরকম তার চোখ ভিজে গিয়েছিল আজও সেভাবেই তার চোখ ভিজলো। আদরের রুমে যেতে চাইল, আর থামাইনি। রুমটা খুলে আদরের রুমে ছেলেটাকে যেতে দিলাম। তারপর একটা সময় কিছু না বলে চলে গেল।

আজ নিজের ৬৭ বছর জন্মদিনের দিন পুরনো এসব কথা মনে পড়ল। আমি কি বাবা হিসেবে আদৌ সার্থক? জীবনের সাথে তালে তাল মিলাতে গিয়ে আমি আমার নিজের অস্তিত্ব ভুলে গিয়েছিলাম একসময়। আমি ভুলে গিয়েছিলাম আমি কোন পরিবার থেকে উঠে এসেছি, আমার জন্ম কোথায় ছিল, আমার পরিবার কি ছিল, কিভাবে আমার বিয়ে হয় এবং আমার বিয়ের জন্য যে আমার স্ত্রী তার পরিবারকে হারায়। আমি ভুলে গিয়েছিলাম যে আমি নিজেও প্রেম করেই বিয়ে করেছিলাম। আমি ভুলে গিয়েছিলাম রায়হানের জায়গায় এক সময় আমিও ছিলাম। আমার স্ত্রী তার বাবার চোখ ফাঁকি দিয়ে পালানোর সুযোগ পেয়েছিল হয়তো কিন্তু আমার মেয়ে আমার বুদ্ধির কাছে হার মেনে যায়। আমি আমার জিদের কাছে আমার ভাবনার কাছে আমার মেয়ের সুখ দেখতে পাইনি তখন। আমি তখন দেখতে পাইনি টাকাই জীবনের সব না। আমি যেমন আমার মা হারা মেয়েকে কঠোর পরিশ্রম করে বড় করেছি ঠিক তেমনি খুব সহজে তার ভবিষ্যত নিজের হাতেই নষ্ট করেছি। মানুষ অনেক সময় জীবনে কোন একটি বিষয়ে কঠোর পরিশ্রম করেও চরমভাবে ব্যর্থ হয়। যেমন আমি। রানু কে হারানোর পর আমার জীবনের প্রধান লক্ষ্য ছিলই আমার মেয়ে আদরকে সুখী রাখা। কিন্তু আমার সেই লক্ষ্যের জন্যই আমার মেয়েকে অকালে মরতে হলো। টানা চার বছর তাকে নির্যাতন সহ্য করতে হলো। আর কত দিন বাঁচবো জানিনা। এই দুনিয়ায় আজ আমি বড্ড একা।

হাসিব সাহেব মারা যাওয়ার চার দিন পর তার লাশ বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয়। বাসায় উনি একাই থাকতেন। মেয়ে এক বছর আগে সুইসাইড করে মারা যায়। ধারণা করা হয় হার্ট এটাকে মারা গেছেন। উনার কোন আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ পাওয়া যায় না। সাত দিন পর রায়হান নামের একজন লোক আসে উনার লাশ দাফন করার জন্য। রায়হান নিজেকে আদরের হাসবেন্ড বলে পরিচয় দেন। যদিও পড়ে সবাই জানতে পারে রায়হান আসলে অবিবাহিত। কিন্তু এই নিয়ে পরে আর কোন মাথাব্যথা কারোর হয়নি।



0
0
0.000
2 comments
avatar

Congratulations @aihtnyc! You have completed the following achievement on the Hive blockchain and have been rewarded with new badge(s):

You distributed more than 100 upvotes.
Your next target is to reach 200 upvotes.

You can view your badges on your board and compare yourself to others in the Ranking
If you no longer want to receive notifications, reply to this comment with the word STOP

Support the HiveBuzz project. Vote for our proposal!
0
0
0.000