উদ্দ্যেশ্যহীন-১ঃ বালেশ্বরের বাঁকে, পায়রার ঝাঁপিতে (বরগুনা)
বরগুনা- সোনাকাটা (কুমির প্রজনন কেন্দ্র)-নলবুনিয়া (শুভ সন্ধ্যা)-হরিণঘাটা- ছনুবুনিয়া (বালেশ্বর নদী)-তালতলী বাজার-বরগুনা
ঢাকায় থেকে চিরকাল এখন সরকারি চাকরির ঘানি টানতে বেচারার পোস্টিং হয়েছে এই সুদূর বরগুনায়। মেয়েটা সারাজীবন দুধে-ভাতে থেকে, প্রচন্ড মেধাবী আর উচ্চ উচ্চ সব ডিগ্রী নিয়েও, এখন পেতে বসেছে সংসার এই অজপাড়াগাঁয়ে, তাও আবার একেবারেই একা।
মায়ের চেয়ে মাসি'র দরদ ক্ষেত্র বিশেষে খানিকটা লাই দেয়াই যায়। তাই আমার মনে হলো যায়, মেয়েটাকে দেখে আসি কেমন আছে সেখানে, কি করছে, কি খাচ্ছে, সত্যই বড় দুশ্চিন্তা হচ্ছিলো।
সরকারি কোয়ার্টারের একখানি ছোট্ট ঘরে ঘাঁটি গেড়েছে সে। মোটামুটি ঢাকা থেকে সব নিয়ে-থুয়ে গুছিয়ে বসেছে। কিন্তু ও কি! রাজকন্যা রীতিমত রাখাল ছেলের সংসার করছে বললে অত্যুক্তি হবেনা। তবুও একবারও বলতে শুনলাম না "ভালো নেই।"
দেখে খুব গর্ব হলো। কিন্তু কি আর করা। তার মামা-চাচা অনেক থাকলেও সে দুর্র্নীতি হবেনা ধরে নিয়ে সেসব কাজে লাগায়নি। অথচ কাজে লাগালে অন্তত রাজধানীতে না হলেও নিদেনপক্ষে যুৎসই কোথাওতো হতো।
যাক সে কথা।
বরিশাল থেকে রওনা দিয়ে রাট দশটা নাগাদ পৌঁছে গেলাম বরগুনা। উঠলাম তার
বাসায়। বেশ বন্দোবস্ত করে পরের দিন একখানা ছুটির উপায় করতে পারলো সে. রাত্রে বেলা খেয়ে দিয়ে খানিকক্ষণ গল্প গুজব করে ঘুমিয়ে পরেলম। ইচ্ছে ছিল ভোর ভোর বের হবার।
সত্য বলতে বরগুনায় দেখার কিছু নেই তেমন। কিন্তু আমারতো সেই নোমাদ ঘোরাঘুরি। কোনো বিশেষ নিদর্র্শন থাকাটা জরুরি না। লোকালয় দেখা, ভিন্ন ভিন্ন এলাকার মানুষ দেখা, তাদের কথা শোনা, অভ্যেস দেখা, এসবই ভালো লাগে। কিন্তু ফারুর জন্য কিছুমিছু খুঁজে বের করলাম। সকাল বেলা ওর ডাকেই ঘুম ভাঙলো। সে উঠেই নাস্তাপানি করে ফেলেছে। আমিতো রীতিমত আপ্লুত তার আয়োজনে।
মনে হলো মেয়ে বিয়ে দিয়েছি আর স্বচক্ষে সে কিরকম চমৎকার সংসার করছে সেটা সচক্ষে দেখে খুব তৃপ্তি পেলাম।
খেয়েদেয়ে বেরিয়ে পড়লাম হরেক রকম চরের উদ্দেশ্যে।
রাস্তায় বেরিয়ে লোকজন কে জিজ্ঞেস করতে করতে চলতে থাকলাম।
ঠিক যাচ্ছি না ভুল পথে যাচ্ছি তাও বুঝছিনা।
কেমন জনমানবহীন জায়গা।
বাড়িঘর সব বহু দূরে দূরে।
আমার একটা ব্যাটারি-চালিত অটো-রিক্সা রিজার্ভ করে নিলাম।
কেবল মাত্র বরগুনার গহীনে "শুভ সন্ধ্যা" নামে নলবুনিয়া এক সমুদ্র সৈকত আছে কেবল ওটাই একমাত্র স্থির গন্তব্য, বাকিগুলো উদ্দেশ্যহীন।
যাচ্ছিতো যাচ্ছিই।
মনে হচ্ছে এর কোনো শেষ নেই।
সেই ছোট্ট নির্জন সৈকতে বেশ ভালোই লাগলো। অনেকটা মহেশখালি'র সোনাদিয়া সমুদ্র সৈকতের মতন, কেবল আবহটা ভীন্ন।
কিছুক্ষন থেকে, ঘুরে ফিরে আবার রওনা দিলাম।
খুব বেশিক্ষন থাকা গেলোনা যেহেতু বাকি জায়গা গুলার দূরত্ব হিসাব করা গেলো না।
চললাম আশার চরের খোঁজে।
যাত্রাপথে অনেককেই জিজ্ঞেস করলাম কেউ সেরকম হদিশও দিতে পারলোনা।
যেতে যেতে আমরা সুন্দরবনের সীমানায় চলে গেলাম, সোনাকাটায়।
তবে সেখানে যেতে হবে গাড়ি রেখে।
একটা সাঁকো পেরিয়ে উপরে যেতে হবে।
হাঁটতে হবে অনেকখানি।
আমি একা হলে হয়তো চলে যেতাম, কিন্তু যেহেতু সাথে ফারু চান ছিল, এই রিস্ক নেবার ইচ্ছে হলোনা, যদিও যে যাবার বায়না ধরেছিলো। কিন্তু আশেপাশের লোকজন নিরাপত্তা নিয়ে খুব একটা আশার বাণী শোনাতে না পারায়, অগত্যা সেটা বাদ দিয়ে সামনে এগিয়ে চললাম অন্যদিকে।
সুন্দরবনের কোল ঘেঁষেই অনেক বাড়িঘর অনেক দেখলাম।
এলাকার মন্তব্য থেকে বুঝলাম, এগুলা জমির কোনো মালিকানা নেই, এখানে যারা থাকে তাদের বেশরিভাগই এই এলাকারও না।
চট্টগ্রাম বা উত্তরাঞ্চলের মানুষ, চিঙড়ি ধরতে আর ব্যবসা ফাঁদতেই এখানে এসে অস্থায়ী আবাস গেড়েছে।
মাইলের পর মাইল পাড়ি দিয়েও, আমরা আশার চর খুঁজে না পাওয়ার নিরাশায় দুলছি যখন, তখন ড্রাইভার পরামর্র্শ দিলো, "হরিণঘাটা" নামক এক জায়গায় নাকি চমৎকার ইকো পার্ক আছে। কাছাকাছি পৌঁছে বাইরে থেকে উঁকিঝুঁকি মেরে আন্দাজ করলাম, যেহেতু সময়ের টান আছে, এই জায়গায় ভেতরে খরচ করবার সময় হাতে নেই। আবার ভেতরে অমন আহামরিও কিছু না।
তাই আশপাশটা একটু ঘুরে ওখান থেকে বালেশ্বর নদীর উদ্দেশ্যে চললাম ছনুবুনিয়া।
সিদ্ধান্ত ভালো ছিল এইটা।
এতবার এত নদ-নদীর রূপ এতভাবে দেখেছি, তবুও যেন সবসময় নতুন এক সৌন্দর্যে ধরা দেয় প্রতিটা নদীই।
পায়রা যদি আর আর বালেশ্বর যেখানে মিশেছে সেই মোহনায় আমরা উপভোগ করলাম নদীর এই অপার সৌন্দর্য।
যাবার সময়তো গেলাম ইচ্ছেমত, আসবার সময় হলো বিপদ। সন্ধ্যার আগে পৌঁছানো চাই, অন্তত তালতলী-বাজারে সন্ধ্যার আগেই পৌঁছাতে হবে। অটো রিক্সাওয়ালা বেশ ঝানু ছিল। ঝাঁকুনির চোটে নাড়িভুঁড়ি এক করে সে সন্ধ্যে নাগাদ তালতলী বাজারে পৌঁছে দিল।
সাদারদিনের দৌড়াদৌড়িতে খিদের কথা খেয়ালে আসে নি, কিন্তু বাজারে ভাতের-হোটেল চোখে পড়তেই খিদাটা একেবারে চেগিয়ে উঠলো। কিন্তু বাজার থেকে আবার নির্দিষ্ট সময়ের পর আর গাড়ি চলাচল করে না। তবে হোটেলের বয়রার কাছে শুনলাম এখান থেকে নাকি বাইক যায়। শুনে খুশি হয়ে গেলাম, যাক আর চিন্তা নেই, একটানে আমতলী চলে যাব। কিন্তু বিপত্তি হলো শুনে যে ফারু-চান কখনো বাইকে চড়েনি এবং তাতে তার বেশ শঙ্কা আছে। এমন একটা ব্যাপার এটা যে এতে জোরাজুরি চলেনা। উৎসাহ দেবার চেষ্টা করলাম তবুও এবং সত্যই কাজ হলো। মনে মনে একশবার ধন্যবাদ জ্ঞাপন করলাম এই সাহস করবার জন্য ওকে।
এরপর নিচিন্তে খেতে বসলাম।
আলু দিয়ে দেশি মুরগির ঝোল, সবজি আর ডাল দিয়ে পেট টান করে খেলাম। খেয়ে এক প্রস্থ চা খেলাম। তারপর চেপে বসলাম মোটরসাইকেলে।
ভয়ানক সে ভাঙাচোরা রাস্তা। মনে মনে বেচারি আমাকে ক'শ গালি দিল কে জানে।
বেশ সংকোচে জিজ্ঞেস করলাম "কেমন লাগলো যাত্রা?"
বললো "যতটা ভয় লাগবে ভেবেছিল অতটা লাগেনিয়া, আর রাস্তা ভালো হলে আরো উপভোগ্য হতো ব্যাপারটা।"
শুনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
ফিরে ও রান্নায় লাগলো, যদিও বারণ করলাম।
খিচুড়ি, বেগুন ভাজা, আর গরুর মাংস।
একেবারে কৃতজ্ঞতায় গদগদ আমি।
খেয়ে সিটিয়ে ঘুম দিলাম।
All the contents are mine, until it's mentioned.