পিতার সকল আশার প্রদ্বীপ সন্তানের জীবনের নিরাশার ঝড় নিভিয়ে দেয় । (My participation 4Th BDC writing competition)

avatar
(Edited)

"হ্যারে বাবা! আমি তোমার কাকুর কাছ থেকে কি শুনলাম এটা! তুমি নাই সিগারেট খাওয়া শুরু করেছ, তোমার ভবিষ্যৎ, তোমার জীবন তুমি ভালো বুঝবে, আমি আর কখনো এই বিষয় নিয়ে তোমাকে কিছু বলল না। তোমার বাবা হিসাবে, তোমাকে সতর্ক করাটা দায়িত্ববোধ মনে করেছি তাই করলাম, বাকিটা তোমার ইচ্ছে"। তারিখটা আমার সঠিক মনে পড়ছে না, তখন আমি ইন্টারমিডিয়েট দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। তারিখটা সঠিক মনে না থাকলেও, আমার বাবার প্রতিটা কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে, কারন আমার সার্বিক জীবনের কৃতকর্মের জন্য অনুসুচনার প্রথম যোগান দিয়েছিল অামার বাবার এই কথাগুলোই। আমার বাবার কথাগুলোর অর্থ যদি আমি সেদিন বুঝতে পারতাম, তাহলে আজকে আমার জীবনটা হয়তোবা অন্যরকম হতো। হয়তোবা আমার বাবা আমাকে নিয়ে যে আশার রাজ্যে সুখের প্রাসাদ গড়েছিলেন, সেই আশার রাজ্যের সুখের প্রাসাদে আমার কৃতকর্মের জন্য আজ নিরাশা নামের এক শয়তানের বসবাস। জানি নিরাশা নামের শয়তানটা আমার বাবার জীবনকে নিয়ে কিভাবে ছিনিমিনি খেলছেন, তাকে নীরবে, নিভৃতে কিভাবে জ্বালাতন করছেন, তার মানসিক এবং শারিরীক সামর্থ নিয়ে, সেই সুখের প্রাসাদের বন্ধ কোন ঘরে অট্টহাসি হাসছেন, এবং হয়তোবা তা বারবার প্রতিধ্বনিত হয়ে আমার বাবার আত্মবিশ্বাসকে ভেঙ্গ দেবার নিরন্তন চেষ্টা করছে। "পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্মঃ পিত্য হি পরমং তপঃ, পিতরি প্রীতিমাপন্নে প্রিয়েন্ত সর্বদেবতা" অর্থাৎ পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম, পিতাই শ্রেষ্ঠ তপস্যা, পিতা সন্তুষ্ট হলে দেবতারাও সন্তুষ্ট হন। হিন্দু ধর্ম গ্রন্থ শ্রীমদভগবদ্ গীতায় পিতাকে এভাবেই বর্ননা করা হয়েছে কারন পিতার মতো মহানুভব ব্যক্তি এই পৃথিবীতে আর কেউ হতে পারে না।

IMG_20200703_024112.jpg

আমার জন্মদাতা পিতা মহানুভবতায় আমার কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ। আমি জানি আমাকে নিয়ে আমার পিতা যে আশায় বুক বেধেছিলো সেই আশা নিরাশার অগ্নি শিখায় দাউ দাউ করে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আমার পরম পূজনীয় পিতা কিন্তু সেই আগুনে পুড়ে ছাই হয় নাই। বরংচ সেই আগুন আমার পিতার অন্তর স্বত্ত্বাকে পুড়িয়ে কয়লা থেকে স্বর্ন নয় হীরায় রূপান্তরিত করেছে। তাই তিনি তার বিগড়ে যাওয়া বড় সন্তানের হাত এখন অবধি ছেড়ে দেন নাই। খুব শক্ত করে ধরে রেখেছেন এবং এবার তিনি ব্যতিক্রম কিছু করেছেন, আমাকে নিয়ে আশার ঘর তিনি বাধেন নাই, অাশার ঘর বেধেছেন আমার মাঝে, যাতে করে আমি বুঝতে পারি যে আশা যদি নিরাশার নোনা জলে ডুবে যায়, সেই ক্ষতটা নোনা জলের আবাসস্থল সমুদ্রের মতোই গভীরতম হয়।

আমার পিতার এমন চেষ্টা, আমার পিতাকে আমার কাছে অতিমানব করে তুলেছে। অতিমানব কেন বলছি ভাই, একদিন না একদিন আমরা সকলে তা বুঝতে পারব, যেদিন আমরা সন্তানের জনক হবো এবং আমাদের সন্তান আমাদের আশায় গুড়েবালি করবে। আমার বাবার নামটাইতো এখন অবধি আপনাদের বলা হলো না। এই মহান ব্যক্তির নাম বিনয় চন্দ্র বর্মন। যথার্থই তাহার নাম, বিনয়। বিনয়ের সর্বোত্তম উদাহরন আমার বাবা। ওনার স্বভাব এতো পরিমান বিনয়ি যে উনি এখন অবধি কোনদিন আমার গায়ে হাত তোলেন নি। আমাকে রাগান্বিত হয়ে কখনো কোন কথা বলেন নাই। কারন তিনি বিশ্বাস করেন আমি বিনয়ি হলে, আমার সন্তানরাও বিনয়ি হবেন, এবং বিনয়িরা জীবন যুদ্ধে পরাজিত হলেও, তার কাছে সম্মানের কোন অভাব থাকে না, অার সম্মান নিয়ে সমাজে বেচে থাকার সুভাগ্য কতোজন ব্যক্তির হয়ে থাকে। আমার বাবা শুধু আমাদের গ্রামেই নয়, আমাদের সমগ্র উপজেলায় একজন সম্মানি ব্যক্তি শুধু তার বিনয়ি স্বভাবের জন্য। আমি বিগড়ে যাওয়ায় আমার বাবার সম্মানে একটু ঘাটতি দেখা দিলেও উনি নিজের সন্তানের প্রতি বিনয়ি হতে বিন্দু মাত্র দ্বিধা বোধ করেন নাই, এবং আমার প্রতি তার বিনয়ি মনোভাব ওনার সম্মানকে বহুগুনে বৃদ্ধি করেছে। কারন কতজন পিতা তার বিগড়ে যাওয়া সন্তাকে আলোর পথ দেখানোর জন্য তার বিগড়ে যাওয়া স্বভাবের সকল প্রকার নষ্টামি সহ্য করে তাকে, পুনরায় পৃত্তিস্নেহ দিয়ে আলোর পথে আনার চেষ্টা করে।

আমি ছোটবেলা থেকেই খুবই কৌতুহলি ছিলাম, অমার বয়সের অন্য ছেলে মেয়েদের থেকে একদম অালাদা। অতিমাত্রায় দুষ্ট স্বভাব এবং প্রচন্ড পরিমানে উপস্থিত বুদ্ধি,আমার পিতার চিন্তার কারন ছিল। কারন ছোটবেলা থেকেই মানুষকে খুব সহজেই আকৃষ্ট করার এক অসীম ক্ষমতা ছিল আমার মাঝে। তাই আমার বন্ধুকুলের কোন অভাব ছিল না। বাবা মার ভয়টা ছিল ঠিক এখানেই ছিল, যা আমি এখন খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারি, যে আমি অসৎ কোন সঙ্গীর সানিদ্ধে যদি চলে যাই তাহলে আমার কৌতুহলী মন আমাকে খুব সহজেই খারাপ পথে নিয়ে যাবে। এবং আমার জীবনে ঠিক তেমনটাই ঘটল আমার উচ্চমাধ্যমিক জীবনের শেষ সময়কালে। আমি নেশা করতে শিখে গিয়েছিলাম, এবং নেশা আমার সকল হিতাহিত জ্ঞান শূন্য করে দিয়েছিল। অতিমাত্রায় মেধাবী হওয়ায় কারনে নেশায় আসক্ত হয়েও আমি উচ্চমাধ্যমিকে ভালো ফলাফল করি। ২০০৯ সালে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জি,পি,এ ৪.৯০ অর্জন করি। মাধ্যমিকে জি,পি,এ ৫.০০ পেয়ে আমার পিতার মনে যে অাশার বাসা আমি বাধিয়েছিলাম সেই আশা তখন অবধি শেষ হয়ে যায় নাই। আমাকে আমার বাবা একজন ডাক্তার হিসাবে দেখতে চেয়েছিলেন, এবং আমার দুই বারের চেষ্টা ব্যর্থ বলে পর্যবেশিত হয়েছিল।

এই প্যারাটা লিখতে আমার হাত থর থর করে কাপছে। কারন এ এক কঠিন বাস্তবতা যা শোনার পর হয়তো আপনি বিশ্বাস করতে পারবেন না এবং যদিও বা বিশ্বাস করে থাকেন তা হলে আমার বাবাকে আপনি আপনার হৃদয়ে অন্য এক জায়গায় অবস্থান দিবেন এবং আমৃত্যু ওনার কথা আপনার হৃদয়ে গেঁথে থাকবে। আমি দুইবার যখন মেডিকেল চান্স পেলাম না, আমার বাবা বিন্দু পরিমান হতাশ হন নাই। উনি আমাকে চট্টগ্রামের এক বেসরকারি মেডিকেল কলেজ যার নাম বিজিসি ট্রাস্ট মেডিক্যাল কলেজ এবং হাসপাতাল এ ভর্তি করিয়ে দেন। বিধাতার এমন খেলা আমার প্রথম সেমিষ্টার শেষ হবার পড়েই আমার বাবা যে এনজিও তে কর্মরত ছিল, সেই এনিজও তার কার্যক্রম অত্র এলাকা থেকে বাতিল করে ফেলেন। পরিনামে বাবা বেকার হয়ে পড়েন। আমি এমবিএস ছেড়ে দিতে চাই। বাবা আমাকে অাশ্বাস দেন তার সঞ্চিত অর্থ আছে সেটা দিয়ে তোমার ডাক্তারি শেষ হয়ে আরও বেশি হবে। তখন অবধি আমি জানতাম না আমার বাবার কোন সঞ্চিত অর্থ নাই। হঠাৎ বাবা একদিন চট্টগ্রাম চলে আসে আমাকে না জানিয়ে। দিনটি ছিল শুক্রবার বাবা হঠাৎ আমার বাসায় আসে এবং বলে বাবা আমি একটা চাকুরী পেয়েছি এবং তা খুবই ভালো। একমাসের জন্য সিঙ্গাপুর যেতে হবে প্রশিক্ষন এর জন্য। আজকে রাতেই ফ্লাইট। আমার সাথে আরও কয়েকজন যাবে। আমার বাবার চোখের ভাষা আমি সেদিন বুঝতে পারি নাই। বুঝতে পারলে হয়তো ওনাকে যেতে দিতাম না। বাবা একমাস পর যখন দেশে ফিরলেন এক জৈনিক ব্যক্তি আমাকে ফোন কল করে বাবার সাথে দেখা করতে বললেন। চট্টগ্রামের ডিসি হিল নামের এক জায়গায়। আমি ভদ্রলোকের বাড়িতে গেলাম মনের ভিতর এক অাজানা অস্থিরতা নিয়ে। ওনার বাসায় গিয়ে দেখলাম আমার বাবা এবং একজন বয়স্ক ভদ্রলোক পাশাপাশি এক বিছানায় শুয়ে অাছেন। আমি কিছু বলার আগেই ওই বয়স্ক ভদ্রলোকের স্ত্রী আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে লাগলেন এবং বলতে লাগলেন তোমার আব্বুকে যদি আমি শুধু মানুষ বলি আমার পাপ হবে, উনি একজন ফেরেস্তা, আমি ওনার কথা কিছুই বুঝতে না পেরে ওনাকে জিঞ্জাস করলাম কেন? উনি বললেন তোমার অাব্বু তার নিজের একটা কিডনি দান করে আমার স্বামির জীবন বাচিয়েছেন এবং তার বিনিময়ে প্রথমে তিনি কিছুই চান নাই। আমরা যখন তাকে কিছু দিতে চেয়েছি তিনি শুধু বলেছেন তোমাদের লেখাপড়ার খরচ চালাতে। এই কথা শোনার পর আমি জীবনের প্রথম বুঝতে পেরেছিলাম আমার পায়ের নিচ থেকে মাঠি সরে যাচ্ছে। সবকিছু কেমন যেন স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিল আমার কাছে। আমি কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম সেদিন, শুধু এটা ভেবে এই কথা আমি আমার মাকে বলল কিভাবে!!!

বাবা সুস্থ হলে আমি ওনাকে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাই এবং আমার পরিবারকে সবকিছু খুলে বলি। আমার পরিবারের প্রতিক্রিয়া দেখে আমি অবাক হই, কেউ বিন্দু পরিমান কান্না করেন নাই, সবার মাঝে আমার বাবার জন্য গর্ববোধের এক উজ্জ্বল আলো দেখতে পেলাম এবং সকলেই বাবাকে ধন্য ধন্য করতে লাগল। কিন্তু বিষয়টা অামি কোন ভাবেই মেনে নিতে পারছিলাম না তাই সেদিন রাতেই আমি চট্টগ্রাম ফিরে অাসি এবং আমি এম,বি,এস ছেড়ে একই বিশ্বিবদ্যালয়ের ফার্মাসি বিভাগে নিজেকে ভর্তি করি এবং প্রথম সেমিস্টারে আমি স্কলারশিপ পেয়ে যাই।

যে ব্যক্তিকে আমার বাবা কিডনি দান করছেন তাদের অনেক টাকা পয়সা অাছে, কিন্তু আমি কখনোই চাই নাই, আমার বাবার এই ত্যাগের বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে আমরা অার্থিক কোন প্রকার সাহায্য নেই। যদি নেই তাহলে আমার বাবার সেই ত্যাগ বিনিময় হয়ে যেত। আমার বাবা চেয়েছিলেন আমি একজন ডাক্তার হই। কিন্তু নিজে উপার্জন করে বেসরকারি কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অসম্ভব একটা বিষয় ছিল। তাই আমার পিতার সেই স্বপ্নকে, আমাকে নিয়ে সেই আশাকে আমি জলানজ্বলি দিতে বাধ্য ছিলাম।

আমি এবং আমার বাবা দুজনে মিলে আমাদের পরিবারের দায়িত্ব নিয়েছিলাম সেই ২০১৩ সাল হতে, সৃষ্টিকর্তার কৃপায় আমরা এখন অনেক সুখি। আমি ডাক্তার হবার চেয়ে নিজের পরিবারের পাশে দাড়ানোটাকে উত্তম ভেবেছিলাম এবং এখন অবধি তাই করছি। আমি আমার বাবাকে কখনো আমার কাছ থেকে দুরে রাখি না। আমার মা এবং ছোটবোন গ্রামে থাকলেও আমার বাবা অামার সাথে ঢাকাতেই থাকেন। কারণ তিনি আমার জীবনের সকল আশার আলো। আমি নিজেকে নিয়ে খুবই গর্ববোধ করি এমন পিতার সন্তান হবার কারনে। আমার বাবার নিরাশার ছাই গুলোতে আমি শীতল পানি ঢেলে নিশ্চুপ করার যথেষ্ট চেষ্টা করে যাচ্ছি, তাই ২৯ শে পা দিয়েও এখন অবধি বিবাহ করার চিন্তা মাথায় অানার বিন্দুমাত্র চেষ্টাও করি নাই।

সকলে দোয়া করবেন আমার পিতার সার্বিক সুস্থতার জন্য এবং বর্তমানে উনি আমাকে নিয়ে যে আশার স্বপ্ন দেখেন, আমি যেন তা বাস্তবায়ন করতে পারি।

অসংখ্য ধন্যবাদ সবাইকে, ব্যস্ততার কারনে লিখতে অনেকটাই দেড়ী হয়ে গেল। ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা রাখি, কারন নিরাশা মানুষকে পরাজিত করে।



0
0
0.000
2 comments
avatar

This post earned a total payout of 0.198$ and 0.099$ worth of author reward that was liquified using @likwid.
Learn more.

0
0
0.000