একটা বাস আর চানভানুর মন খারাপের এক রাত

avatar

নয় নম্বর লক্করঝক্কর বাসটা এসে কল্যাণপুর বাসস্ট্যান্ডে থামে, আর কাজ শুরু হয় চানভানুর। এই আদিকালমার্কা নামটা তার কে রেখেছিলো তা সে বের করতে পারেনি আজতক। কাউকে বললে নাম, হেসেই উড়িয়ে দেয়। অবশ্য তার রাস্তার কাজে কারো সাথে খুব বেশি পরিচিত হতে হয় এমন না।

চানভানু শুনলে কেমন যেন চাঁদ ভেঙে পড়েছে এমন শোনায়। হিজাবের আড়ালে ঢাকা চানভানুর চেহারা সত্যিকার অর্থেই তেমন, যেন পূর্ণিমার চাঁদের আভা ভেঙে পড়েছে মুখে। কিন্তু মুখ তো দেখানো মানা এই রাস্তায়।

ঢাকাশহরের বাসগুলোর জানালা বন্ধ থাকেই না বলতে গেলে। এত গরম আর ভিড়ের হাঁসফাঁসে জানালার পাশে বসা মানুষটা বাসের জানালা খোলাই রাখে, একটু বাতাস পাওয়ার আশায়। আর এই খোলা জানালা দিয়েই চেন্নাই হারবালের লিফলেট ছুড়ে দেওয়ার কাজ করে চানভানু। সারাদিন চুক্তি, দিনশেষে তিনশ টাকা কামাই।

A girl in a bus.jpg

Source

এইসব হারবালের বিজ্ঞাপন খুব অজ্ঞতার ভিত্তিতে দাঁড়ানো। বিজ্ঞাপনে প্রস্রাবের সময় গা একটু জ্বারকাটা দিলে ভয়াবহ সমস্যা, এইভাবে লেখা থাকে। আর গ্রাম থেকে ঢাকায় আসা সহজ মানুষটা এই বিজ্ঞাপন পড়ে ধোঁকা খায়। যৌনতা নিয়ে অজ্ঞতা আর ভয়ের উপরে দাঁড়ানো এইসব হারবাল প্রতিষ্ঠান।

তবুও কাজ করে যেতে হয়। প্রতিষ্ঠান ভুল হলেও নিজের কাজটা "অনেস্ট ওয়ার্ক" বলে মানে চানভানু।

এই কাজে কোনো বাঁধা নেই, কোনো ইমোশনাল অ্যাটাচমেন্ট নেই। বাঁধাধরা দাঁড়ানো বাসের জানালা দিয়ে লিফলেট ছুড়ে দেওয়ার কাজ।সেই কাজেই আজ একটু ধাক্কা লাগে চানভানুর। নয় নম্বর বাসটার জানালা দিয়ে লিফলেট ছুড়তে গিয়ে একটা জানালায় লিফলেট বাঁধা পেয়ে ফেরত আসে। জানালা বন্ধ।

লিফলেটটা কুড়াতে কুড়াতে জানালার দিকে তাকিয়ে একটু ধন্দমতো লাগে, আসলেই কী! তার তো চেনার কথা না, চেহারাও মনে থাকার কথা না! সেই কত বছর আগের কথা! কিন্তু মা কী টের পায়? নিজের সন্তানের চেহারা ভুলে? না দেখে/পালন করলেও কি টের পায়?

লিফলেটটা কুড়িয়ে বাসস্ট্যান্ডে চলে আসে সে। কিন্তু আর কাজ করা দম পায় না। ওভারব্রিজের সিঁড়িতে বসে পড়ে।

ওভারব্রিজে বসে ভিক্ষে করে সালমা। এই টাইপ নামে নিশ্চিত হওয়া যায় যে তার নাম রাখার সময় কেউ ওত চিন্তাভাবনার মধ্য দিয়ে যায়নি। বাঙালি হিসেবে প্রথম যে নামটি ক্লিক করে মাথায়, তাই নাম হিসেবে রেখে দেওয়া।

এক জায়গায় কাজ করতে করতে একটা সখ্যতা গড়ে উঠেছে সালমা আর চানভানুর মাঝে। সালমা হাঁটতে পারে না, গোঁদরোগ। পা ফুলে ঢোল৷ সালমাকে ট্রলি ঠেলে নিয়ে আসে চানভানুই। একই বস্তিতে বাস দু'জনের।

সালমা- কী রে চানবানু, বইসা পইড়লি যে? খারাপ লাগে?
চানভানু- মনে একটা ধাক্কা খাইছি রে, বইন?
সালমা- কী হইছে?
চানভানু- এই যে মাত্তর বাসটা গেলো না, ওই বাসে মনয় আমার মাইয়াডা গেলো!
সালমা- কোন মাইয়া? বেইচা দিছিলি যেডারে?
চানভানু- হ।
সালমা- বেচছিলি ক্যান জানি?
চানভানু- মরণ! মনে থাহে না তর কিছু!

বলে আলতো করে চোখ মুছে উঠে যায় চানভানু। কাজ তো করতে হবে! গল্প করতে দেখলে ওভারব্রিজে দাঁড়িয়ে থাকা সুপারভাইজার দিনের বেতন কেটে নিবে। এমনিই টানাটানি, বেতন কেটে নিলে অনেক সমস্যা।

দিনশেষে, সন্ধ্যায় ঘরে ফেরার পথে সালমা আবার কথাটা তোলে।

সালমা- এমন মন খারাপ কইরা থাহিস না, ক না, কয়া ফালা, ভালা লাগবো।
চানভানু- কী কমু?
সালমা- কী দেখলি? ক্যান মনে হইলো?
চানভানু- জানি না ক্যান মনে হইলো। দেখতেই ক্যান জানি মনে একটা ধাক্কা লাগলো। মনে হইলো আমারই কেডা জানি যায়। কেমন হালকা হালকা লাগলো, জানি কেমন কিছু নাই আমার লগে।
সালমা- এই থেইকা বুঝলি?
চানভানু- পোড়ামুখি, প্যাটে ধরছোস কোনোদিন তুই বুঝবি?
সালমা- ও! আমার নয় প্যাটে ধরার খ্যামতা নাই। তুই জানি ক্যামনে প্যাটে ধরছিলি? রাস্তায় রাস্তায় না শুইয়া বেড়াইতি তহন!

চানভানু কী যেন বলতে গিয়ে থেমে যায়। ট্রলি ঠেলা ছেড়ে দিয়েছিলো, দীর্ঘ একটা শ্বাস ছেড়ে আবার ট্রলি ঠেলতে থাকে৷

বেশ খানিক সময় চুপচাপ কেটে যায়। নীরবতা ভাঙে চানভানু।

চানভানু- হ, তহন তো মনে হইতো এই কয়দিন, যামু গা মইরা। আমাগো জন্মের ঠিক নাই, মরণের ঠিক নাই। কয়ডা দিন খায়াপইড়া গেলেই হয়। শুইতাম যার তার লগে। ট্যাকা পাইতাম, উড়াইতাম। তখনই প্যাট বাধায়া বইছিলাম। ভাবছিলাম, এমনে তো ডিমান্ড ভালোই আছে, সমস্যা হইবো না। কিন্তু, পোলা মানুষ, ভাবে পোলাপান হইলে মাইয়াগো ওই জায়গা বড় হয়া যায়, কাম কইরা আরাম নাই। তাই খদ্দেরও কইমা যায়।

সালমা- পরে?

চানভানু- পরে এক রাইতে একটা গাড়ি আইসা থামে। গাড়ি থেইকা এক ম্যাডাম নাইমা আইসা কয় বাচ্চাডা তারে দিয়া দিতে। হ্যায় ঠিকঠাক লালন পালন করবো।

সালমা- আর তুই দিয়া দিলি?

চানভানু- কী করমু? নিজের প্যাটে খাওন নাই, বুকে দুধ নাই, বাচ্চাডা কান্দে। মনে হইলো কী আর হইবো, বাচ্চাডা ভালা থাকবো। দিয়া দেই।

সালমা- এসব ভাইবা লাভ নাইকা। আল্লাহ যা করে ভালোর লাইগাই করে। ঘুমা গা অহন

হাঁটতে হাঁটতে সালমার বস্তিঘরের সামনে চলে এসেছে দুইজন। সালমাকে রেখে নিজের ঘরের দিকে হাঁটতে থাকে চানভানু, আর ভাবতে থাকে, হয়তো জীবনে চলার রাস্তার প্রতিবন্ধকতায় কালকেই এই কষ্টের কথা ভুলে যাবে সে, হয়তো সময়ের এই অনন্তকাল নিরবধি বয়ে চলায় আমাদের এই ক্ষুদ্র অনুভূতির কোনো দাম নেই, কিন্তু এই মুহূর্তের, ঠিক এই মুহূর্তের কষ্টটা, দুঃখটা, আক্ষেপটা তো আসল।

তাই না?



0
0
0.000
4 comments
avatar

@tajimkhan vai bdvoter theke vote pawar way ta bolben plz!

0
0
0.000
avatar

Its up to the bdvoter only. Like all the curator if bdvoter thinks a post is worthy of curation, it will be curated. That's it.

0
0
0.000