ফ্ল্যাশব্যাক-১৯৭১: দেশভাগের ক্ষত, বাংলাদেশের জন্ম।
ধর্মের ভিত্তিতে একটা দেশকে দুইভাগ করার ইতিহাস তো আমরা আগেই পড়লাম। একভাগ হলো ইন্ডিয়া, আরেক ভাগ পাকিস্তান। নামে এক দেশ হলেও পাকিস্তানের অংশ আবার দুইটা। একটা হলো পূর্ব পাকিস্তান অন্যটা পশ্চিম পাকিস্তান। এই দুই অংশের মাঝে সংস্কৃতি, ভাষা অথবা মানুষের কোনো মিলই নেই। অথচ শুধুমাত্র ধর্মের কারণে হাজার কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থান করা দুইটা অংশকে একত্র করে নতুন একটা দেশের জন্ম দেয়া হলো।
দেশ ভাগের পর যে এই অঞ্চলের মানুষ সুখে, শান্তিতে বসবাস শুরু করল, তা কিন্তু না। দুইটা দেশই নানা রকম সমস্যার মুখোমুখি হতে শুরু করলো। ভারতের মূল সমস্যা ছিল রিফিউজি সমস্যা ও দেশের বিভিন্ন অংশে মাথা চাড়া দিয়ে উঠা ছোট ছোট কম্যুনিস্ট দলের কার্যক্রম। এরা কম্যুনিজম প্রতিষ্ঠার লক্ষে শ্রেনী শত্রু খতমের নামে ভারত জুড়ে ধনী শ্রেনী লোকদের হত্যা করা শুরু করলো। যদিও ধীরে ধীরে কঠোর আচরনের মাধ্যমে ভারত সরকার তা নিয়ন্ত্রন করতে সক্ষম হয়েছিল।
তবে পাকিস্তানের সমস্যা ছিল আরো প্রকট। বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের আশা ভঙ্গ হতে বেশি সময় লাগে নি। যেহেতু দুই অংশের দূরত্ব অনেক বেশি, পাশাপাশি শিল্প, সংস্কৃতিতে অনেক পার্থক্য, তাই অল্প সময়েই পশ্চিম অংশ কর্তৃক পূর্ব অংশের মানুষদের প্রতি বিরোপ মনোভাব দেখা যেতে পারে। অবশ্য শুরুতেই আঘাত আসে ভাষার উপর। পাকিস্তানের দুই অংশ মিলিয়ে বাংলা ভাষায় কথা বলা মানুষের সংখ্যা বেশি হলেও পাকিস্তান সরকার শুধুমাত্র উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে নির্ধারন করার সিদ্ধান্ত নেয়।
কিন্তু যে জাতি ব্রিটিশ শাসনের সময় গোলামীর পরিবর্তে প্রতিনিয়ত ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলন, সংগ্রাম, বিদ্রোহ করে গিয়েছে, তারা কিভাবে নিজের ভাষার উপর এধরনের আচরন সহ্য করবে? পাকিস্তান সরকারের এধরনের অনৈতিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন শুরু হয়ে গেলো। আন্দোলনের চাপে শেষ পর্যন্ত সরকার উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়।
সে যায় হোক, ভাষার প্রতি আক্রমনের পর এরপর ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক ভাবেও তারা পূর্ব পাকিস্তানকে নাজেহাল করার চেষ্টা করে। এদেশের বাঙ্গালীরা অবাক হয়ে লক্ষ করে যে এতদিন ব্রিটিশটা তাদের সম্পদ নিজেদের দেশে পাচার করতো। আর এখন পশ্চিম পাকিস্তানিরা এসেও একই কাজ করতে লাগলো। পূর্ব পাকিস্তানের সব সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানের পাচার হতে থাকলো।
অথচ রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধার বেলায় বাঙ্গালীরা অনেক পিছিয়ে পড়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানিদের তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানিরা চাকরি, শিক্ষার ক্ষেত্রে বেশি সুযোগ সুবিধা পাচ্ছিল। এরকম অন্যায় আর কতদিন মেনে নেয়া যায়? ফলে ফুঁসে উঠলো বাঙ্গালীরা। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যেভাবে বিদ্রোহ করেছিল, ঠিক সেইম ভাবে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধেও বিদ্রোহ করে বসল।
তবে এবারের বিদ্রোহের রাস্তাটা এত সহজ ছিল না। ১৯৪৭ এর পর আবারও এই দেশের মানুষের রিফিউজির জীবন শুরু হলো। ১ কোটি মানুষ পাকিস্তানি আর্মির হাত থেকে জীবন বাঁচাতে বর্ডার ক্রস করে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। ভারতও আমাদের আশ্রয় দিয়েছিল। দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধের পর ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে এবার নতুন আরেকটা রাষ্ট্রের জন্ম হলো, যার নাম বাংলাদেশ। কথিত আছে, রক্ত যদি হয় স্বাধীনতার মূল্য, তবে বাঙালি জাতি তার স্বাধীনতার জন্য সর্বোচ্চ মূল্যই দিয়েছে।
১৯৪৭ এর দেশ ভাগের পর দুই দেশের মাঝে সবচেয়ে বড় পার্থক্য ছিল গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা। ভারত যেখানে শত সমস্যার মাঝেও নিজেদের গণতন্ত্রকে অটুট রাখতে পেরেছিল, সেখানে পাকিস্তানে নিজেদের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের জন্যই আবারও পাকিস্তানকে ভেঙ্গে ফেলতে হয়েছিল। তবে অবাক করা বিষয় হল ভেঙ্গে যাওয়া পাকিস্তানের একটি অংশ যখন দিন দিন উন্নতির দিকে যাচ্ছে, তখন অপর অংশটি দিন দিন আরো খারাপ পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে।
পাকিস্তান ভেঙ্গে যাবার পর আমাদের বাংলাদেশের শুরুর সময়টাও অবশ্য এত সহজ ছিল না। আগের লেখায় লিখেছিলাম দেশ ভাগের পর ভারত কিরকম সমস্যার মাঝে পড়েছিল। আর এবার স্বাধীনতার পর আমাদের দেশও ঠিক সেইম সমস্যার মাঝে পড়ে গিয়েছিল। একে তো দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধে বহু কিছু ধ্বংস হয়ে গেছে। শিল্প, কারখানা, রাস্তাঘাট কোনো কিছুই নাই, তার উপর চারপাশে লাশ আর লাশ।
তার উপর যুদ্ধের সময় ১ কোটি লোক ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। যুদ্ধ শেষে তারা আবারও দেশে ফিরে আসতে শুরু করে। এই সব শরনার্থীদের বাড়ি ঘর সম্পত্তি বেশিরভাগই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। এত এত মানুষের মুখে অন্ন তুলে দেয়াটা নতুন সরকারের জন্য অনেক কষ্টের হয়ে উঠেছিল।
ব্যাংক নাই, টাকা নাই তবুও তৎকালীন সরকার সাধ্যের মাঝে চেষ্টা করে যাচ্ছিল সবকিছুর সমাধান করতে। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্রের এক অসাধারন মিশ্রনে জাতির জনক শেখ মুজিবর রহমান চেয়েছিলেন বাকশাল প্রতিষ্ঠা করতে।
কিন্তু শত্রুর বুকের আঘাতে উনার জীবনের পাশাপাশি বাংলাদেশের সমস্ত স্বপ্নও যেন নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। দীর্ঘদিন গণতন্ত্রহীন পরিবেশে একটু একটু করে পিছিয়ে পড়তে শুরু করে দেশ। এই অন্ধকার সময়টুকুতে উন্নয়ন যে হয় নি, এমনটাও না। তবে একটা কথা খুব সত্য যে, শিল্প-সংস্কৃতিতে বাংলাদেশের আগের যে কোনো ইতিহাসের চেয়ে এবারের ইতিহাসটা একেবারেই অন্ধকার।
Congratulations @reza-shamim! You have completed the following achievement on the Hive blockchain and have been rewarded with new badge(s) :
You can view your badges on your board And compare to others on the Ranking
If you no longer want to receive notifications, reply to this comment with the word
STOP
To support your work, I also upvoted your post!
Do not miss the last post from @hivebuzz:
বঙ্গবন্ধু কে হত্যার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছিলো।
তা ঠিক। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের পর ক্ষমতা নিয়ে টানাটানি, খুনাখুনী বাংলাদেশকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছিল।