গল্পঃ তারপর রাহেলার কালো চোখে দুটি প্রজাপতি এসে বসলো..

avatar

images (18).jpeg


রাহেলা, রাহেলা...
মা ডাকছেন। এটা মায়ের একটা মুদ্রাদোষ। রাহেলাকে সামনে না দেখলে তিনি রাহেলা, রাহেলা বলে ডেকে ওঠেন। যেন সে এখনো ছোট্টটি রয়ে গেছে। একটু চোখের আড়াল হলে হারিয়ে যাবে। আর কেউ খুঁজে পাবে না।

রাহেলার মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে করে দুরে কোথাও হারিয়ে যেতে। যেখানে কেউ তাকে খুঁজে পাবে না। যেখানে মায়ের রাহেলা, রাহেলা চিৎকার তাকে ব্যতিব্যস্ত করবে না। এমন জায়গা কি আছে? হয়তো এই বিশাল পৃথিবীতে কোথাও না কোথাও আছে। কিন্তু রাহেলার পৃথিবীতে নেই।

20200903_183002.jpg

“রাহেলা, এই রাহেলা.....” মা ডাকতে ডাকতে উঠে এলেন। “কি ব্যাপার? ডাকছি যে কানে যায় না?”

“কেন ডাকছিলে?”- রাহেলা স্মিত হেসে বললো।
“এমনি” -মা রাগ দেখিয়ে চলে যান। কিন্তু রাহেলা জানে, মা আসলেই তাকে কোন কারন ছাড়া ডেকেছেন।

সে চোখের আড়াল হলে মার দুশ্চিন্তা বেড়ে যায়। নইলে তিনি এমনি এমনি রান্নাঘর থেকে বের হতেন না। আজ সালেহা আপু আসবে দুলাভাই-সহ। মা সেই ভোরে যে রান্না ঘরে ঢুকেছেন, আর বের হননি। রাহেলা পাশের রুমে বসে হাড়ি পাতিলের ঘটঘট আওয়াজ শুনছে তখন থেকে।

এই একটা জিনিস রাহেলার কাছে অবাক লাগে। সালেহা আপুর শশুরবাড়ি থেকে কেউ এলে মায়ের আচরন কেমন পাল্টে যায়। তাদের খুশি করতে তার চেষ্টার ত্রুটি থাকে না। অথচ বড় ভাইয়ার শশুরবাড়ির লোকজন এলে উল্টো ঘটনা।

এমন না যে সালেহা আপুর শশুর বাড়ির লোকজন তাদের খুব আদর আপ্যায়ন করে। শেষবার বাবা যখন গিয়েছিলেন আজিজ ভাইদের বাড়িতে, তারা দুপুরে খাওয়ার জন্য সাধে নি পর্যন্ত । দুইটার দিকে তিনি ওই বাড়ি থেকে খালি পেটে বের হন। এই ঘটনার পর রাহেলা ভেবেছিলো, এবার বোধহয় মায়ের আচরন পাল্টাবে। কিন্তু সে অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো- তার দরবিগলিত ভাব আরো বেড়ে গেছে। মেয়ে সেখানে থাকে বলেই কি এই আদিখ্যেতা!

এইসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ডোরবেল বাজলো, রাহেলা টের পেলোনা। হঠাৎ সালেহার চিৎকারে তার ঘোর কাটলো। সালেহা এসেই তাকে জড়িয়ে ধরেছে। কতদিন পর আপুর শরীরের ঘ্রান! রাহেলা অবাক হয়ে দেখলো- তার সেই বোনটি বাকুমের কথা একবারও জিজ্ঞাসা করলো না! বাকুম তাদের একটা পায়রার নাম। যাকে নাম ধরে ডাকলে উড়ে এসে দুই বোনের হাতে বসে আদার খেতো।

এই সালেহাই রাহেলার একমাত্র সই। রাহেলার শৈশব কেটেছে তার সঙ্গে গল্প করে। অন্ধ রাহেলা পৃথিবী দেখেছে সালেহার চোখে। সালেহার বিয়ে হয়ে যাবার পর রাহেলা বড় একা হয়ে গিয়েছিলো। অনেক অনেক রাত সে একা কেঁদেছে। তারপর একদিন এই একাকী জীবনে সে অভ্যস্ত হয়ে গেলো। মানুষের অভ্যাস হলো যে কোন কিছুতে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া।

images (16).jpeg

সালেহাও অভ্যস্ত হয়ে গেলো। সে এখন বাকুমের কথা বলে না। তার গল্পের গন্ডি এখন শাশুড়ি আর ননদের সংসারে বৃত্তবন্দি হয়ে গেছে। শুনতে শুনতে রাহেলা হাঁপিয়ে উঠে। বলে, “আপ্পি, তুমি এখন ক্লান্ত। কথা পরে বলা যাবে। যাও হাত মুখ ধুয়ে আগে ফ্রেশ হও।”

সালেহা উঠে চলে যায়। রাহেলা জানালায় এমন ভাবে তাকায় কেউ দেখলে ভাববে- সে বুঝি মুগ্ধ হয়ে বাহিরের দৃশ্য দেখছে। না দেখলেও রাহেলা ঠিক বুঝতে পারে, সকালের শিশিরগুলো এখন সোনালী রোদ গায়ে মেখে পাতা থেকে পাতায় টুপটাপ করে ভেঙে পড়ছে।

দরজা বন্ধ হবার শব্দ শুতে পায় রাহেলা। সে বুঝতে পারে দুলাভাই পা টিপে টিপে তার পেছনে এসে দাড়িয়েছে। হয়তো তাকে হঠাৎ চমকে দিতে চায়। সে চমকে গেলে দুলাভাই মজা পাবে। তাকে এই মজা থেকে বঞ্চিত করতে ইচ্ছা হলো না। রাহেলা তাই কিছু না বলে চুপচাপ বসে থাকলো।

পেছন থেকে আজিজ ভাই তাকে হঠাৎ জড়িয়ে ধরলো। রাহেলা চমকে উঠার অভিনয় করলো। কিন্তু সে অবাক হয়ে দেখলো- আজিজ ভাই তাকে ছাড়ছে না।

রাহেলা নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য জোড়াজোড়ি করলো। তাতে কাজ হলো। দুলাভাই তাকে ছেড়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, “কি, শ্যালিকা মনে হয় ভয় পেয়েছেন? ভয় পেলে বিয়ের পর কি করবেন? আগে থেকে দুলাভাইয়ের কাছে কিছু শিখে না গেলে তো বিপদে পরবেন।”

রাহেলার এইসব ইঙ্গিতপুর্ন তামাশা ভালো লাগেনা। কিন্তু দুলাভাইকে সেটা বুঝতে দিলো না। এই দুলাভাইয়ের সামনে তার মহা প্রতাপশালী পিতাও নরোম স্বরে কথা বলেন। তার মা দরবিগলিত হয়ে যান। তাকে কিভাবে রাহেলা কটুকথা বলে? সে মৃদু হেসে বললো- “যখন দরকার হবে শিখে নেব। আপনি তো আর পালিয়ে যাচ্ছেন না?”

তার উত্তরে আজিজ যেন কিছুটা সাহস পেলো। বললো, “তাহলে প্রথম পাঠটা আজকেই হয়ে যাক।”

images (17).jpeg

রাহেলা জবাব দেওয়ার আগে সাপের মতো একটা হাত ফোঁস ফোঁস করতে করতে তার শরীর জড়িয়ে ধরলো। তার মুখের ভেতর একটা লকলকে জিহবা ঢুকে গেলো। সে শব্দ করতে পারলো না। সে অনুভব করলো- তার কাপড় ধীরে ধীরে খুলে যাচ্ছে। তার তলপেটে পিঁপড়ার মত কয়েকটি আঙ্গুল পিলপিল করে হাটছে। তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। পুরুষ মানুষের সাথে শক্তিতে সে পারছে না.....

মায়ের ডাকে রাহেলা সম্বিৎ ফিরে পেলো। নিজেকে সে আবিষ্কার করলো খাটের উপর। কি হয়ে গেলো- কিছুই বুঝতে পারছে না। হঠাৎ সে তলপেটে হাত দিলো। খুব ব্যথা করছে।

তিনদিন রাহেলা লুকিয়ে লুকিয়ে থাকলো। কোথায় আর লুকাবে? নিজের ভেতর গুটিসুটি মেরে থাকলো। আপ্পি থেকে, দুলাভাই থেকে দূরে সরে থাকলো। এই তিনটি দিন তার কাছে তিন যুগ বলে মনে হলো।

সালেহা শশুর বাড়ি গেলে সে একটু হাত পা মেলে স্বস্তিতে উঠে দাড়ালো। তার মা-ও জামাই আপ্যায়নের তটস্থভাব থেকে মুক্তি পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।


রাহেলা কয়েকদিন খুব মনমরা হয়ে ছিলো। সে বুঝতো, মা তাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করছেন। তার জন্য কারো শান্তি নষ্ট হোক, এটা সে কখনো চায় না। তাই সে হাসি খুশি থাকার খুব অভিনয় করে। আর সবাইকে ফাঁকি দিলেও মাকে সে ফাঁকি দিতে পারে না।

মা তাকে জিজ্ঞাসা করেন- কোন কারনে মন খারাপ কি না। সে এড়িয়ে যায়। এড়াতে এড়াতে একদিন সে হাসিখুশি থাকার অভিনয়ে অভ্যস্ত হয়ে যায়। মায়ের দুশ্চিন্তা দূর হয়।

সময় গাংচিলের মত ডানা মেলে উড়তে থাকে। মাস পেরিয়ে যায়। একদিন হঠাৎ মা বিষয়টা লক্ষ্য করেন। দুশ্চিন্তায় তার কপাল ঘামতে শুরু করে। তিনি রাহেলাকে আলাদা ঘরে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসা করেন, “কিরে, এই মাসে তোর হয় নাই?”

রাহেলা স্বাভাবিক ভাবে বলে- “না।”

সে জানে না এই একটি না-এর ভিতর যে কত দুঃখ, কত অপমান, কত লজ্জা লুকিয়ে আছে! সে না দেখলেও বুঝতে পারে, আতঙ্কে তার মায়ের মুখ নীল হয়ে যাচ্ছে। সে শুনতে পায়, তার বাবার সাথে মা ফিসফিস করে কি যেন বলছেন। সে অনুমান করে, অশুভ কোন মেঘ এসে হঠাৎ তাদের ঘরের উজ্জ্বল আলো কেড়ে নিয়েছে।

মা তাকে কোথায় যেন নিয়ে যান। জিজ্ঞাসা করলে কিছু বলেন না। ধমক দেন। সে অজানা আশঙ্কায় গুটিসুটি মেরে রিক্সায় বসে থাকে। কিছুক্ষন পর বুঝতে পারে তারা ডাক্তারের কাছে এসেছে। তার কি কঠিন কোন অসুখ করেছে? মাকে আবার জিজ্ঞাসা করে। আবার ধমক খায়।

যা আশঙ্কা করেছিলো, তা ই হয়েছে। মা তাকে জিজ্ঞাসা করেন, “কে তোর এই সর্বনাশ করছে, ক?”

রাহেলা এই বার সব কিছু বুঝে ফেলে। হঠাৎ তার মাথাটা ভীষণ ফাঁকা ফাঁকা লাগে। সে বিছানার উপর পরে জ্ঞান হারায়।


জ্ঞান ফেরার পর রাহেলা বাবার জেরার মুখে পরে। বাবা তাকে বিশ্রী ভাষায় গালগালি করেন। সে লজ্জায় মাথা হেট করে রাখে। কিছু বলতে পারে না। উত্তর না পেয়ে বাবা কোমরের বেল্ট খুলে মারতে শুরু করেন। সে নীরবে কাঁদে। তবু কিছু বলে না।

খবর পেয়ে তার ভাই ছুটে আসে ঢাকা থেকে। এমনিতে জাহেদ ঈদ ছাড়া বাড়িতে পা দেয় না। সে এসে বাবার সাথে মিটিংএ বসে। বলে, “এটা আমাদের মান সম্মানের বিষয়। বেশি জানাজানি হলে লোকের কাছে মুখ দেখাতে পারবো না। আমি রাহেলাকে ঢাকায় নিয়ে এম.আর করাই। কেউ কিছু জানতে পারবে না।”

বাবা বলেন, “কোন শুয়োরের বাচ্চা এই কাম করছে, তারে ছাইড়া দিমু? তার মাংস কাইট্টা আমি যদি কুত্তারে না খাওয়াইছি তো আমার নাম সোবহান খন্দকার না।”

ভাইয়া বাবাকে বুঝাতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। তারপর মাকে জিজ্ঞাসা করে, “হারামীটা কে?”

মা তাকে জানান যে, রাহেলা এখনও কিছু বলে নাই। ভাইয়া হঠাৎ তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে। লাফ দিয়ে উঠে এসে রাহেলার চুলের মুঠো ধরে চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে বলে- “বলবো না মানে? বল মাগী, তোর কোন ভাতারে এই কাম করছে?”

ভাইয়ার মুখের ভাষা শুনে রাহেলা আকাশ থেকে পরে। যে ভাইয়া কোনদিন তাকে মারা তো দূরের কথা, একটা ধমক পর্যন্ত দেয়নি, সেই ভাইয়া তাকে মাগী বলছে!

images (19).jpeg

রাহেলার চোখ ভেঙে কান্না আসে। অন্যপাশ থেকে বাবা আবার চিৎকার করে ওঠেন, “তোর কান্দন আমি বাইর করমু খানকি। ক, কে তোর সর্বনাশ করছে।”

রাহেলা কাঁদতে থাকে। বাবা আর ধৈর্য্য ধরতে পারেন না। উঠে এসে কষে কয়েকটা চড় দেন। তবু নিশ্চুপ দেখে তার গলা চেপে ধরে বলেন, “ওই হারামীরে যখন খুন করতে দিবি না, তোরেই খুন করুম।”

রাহেলার দম বন্ধ হয়ে আসে। সে দাপাতে শুরু করে। তবু বাবার মায়া হয় না। নির্যাতন আর সহ্য করতে না পেরে রাহেলা বলে ফেলে, “আজিজ ভাই।”

তুমুল ঝড় হঠাৎ করে থেমে গেলে অথবা একটা বিশাল বেলুন আচমকা ফেটে গেলে যেমন নিস্তব্ধ মনে হয় চারপাশ, ঘরটা যেন সে রকম নীরব হয়ে গেলো।

রাহেলা না দেখেও যেন স্পষ্ট দেখতে পেলো, বাবা, মা আর ভাইয়ার মুখে রাগের নীল রঙের উপর কে যেন হঠাৎ একগাদা মলিন কালো রং ঢেলে দিলো।

বাবা দপ্ করে সোফার উপর বসে পরলেন। খুব মৃদু স্বরে বললেন, "জাহেদ, ওকে ঢাকায় নিয়ে যা।”

সোবহান খন্দকারের কন্ঠে আগের সেই তেজ আর ঝাঁঝ নেই।

20200627_034755.jpg


আত্মকথনঃ

poster_1593196763985_rd7uzi0du0.gif

আমি ত্বরিকুল ইসলাম। সখের বশে ব্লগিং করি। ব্লকচেইন এবং ক্রিপ্টোকারেন্সি বিষয়ে আগ্রহী।



"পড়াশোনায় ইঞ্জিনিয়ার। পেশায় শিক্ষক। নেশায় লেখক। সাবেক ব্যাংকার। পছন্দ করি লিখতে, পড়তে, ভ্রমণ করতে এবং জমিয়ে আড্ডা দিতে।"


        জীবনটাকে অনেক অনেক ভালোবাসি


0
0
0.000
7 comments
avatar

আমাদের সমাজ এমনই মেয়ের শ্বশুর বাড়ির লোক বলপ কথা!

0
0
0.000
avatar

এই সামাজিক সিস্টেমটা আমার কাছে খুব অসহ্য লাগে। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও যখন দেখি মেয়ের পক্ষে হওয়ার কারণে একটু অবদমিত হয়ে থাকে একটা পক্ষ, আর অপর পক্ষ অন্যায় ভাবে সেই সুবিধা নিতে থাকে, তখন সহ্য করা কঠিন হয়ে যায়।

0
0
0.000
avatar

মেনে নেয়া যায় না, তারপরও চলছে এইভাবে..

0
0
0.000
avatar
(Edited)

আমাদের সমাজটাই এমন। কারো কাছে বাঘ কারো কাছে বিড়াল। কিন্তু অপরাধ ঐ একই।

0
0
0.000
avatar

হ্যা, আমরা মানুষ দেখে আচরণ বদলে ফেলি। একই কাজ করে কেউ পায় পুরস্কার, আবার কেউ পায় তিরস্কার।

এই দ্বৈত নীতি থেকে বের হওয়াটা বেশি জরূরী।

0
0
0.000
avatar

লেখার ভাষ্যটা ভাল ছিল। সমাজ ব্যবস্থার চিত্র এক কথায় প্রকাশ।

0
0
0.000