জিডিপি এবং গোপালের শ্বশুরবাড়ি ভ্রমন || গোপালের অর্থশাস্ত্র (পর্ব ০৩)
অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র'র রাজদরবারে অন্যতম সভাসদ ছিলেন গোপাল ভাঁড়। প্রখর বুদ্ধিমত্তা ও রসবোধের জন্যে দেশব্যাপী গোপালের সুখ্যাতি ছিল। তাঁর বিভিন্ন হাস্যরসাত্মক ঘটনা মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে যায় সারা দেশে। গোপাল ভাঁড়ের হাসির আড়ালে থাকে গভীর জীবনবোধ, সমাজ সচেতনতা এবং গভীর জ্ঞানের ইঙ্গিত।
গোপাল একবার শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার জন্য বের হয়েছে বাসা থেকে। গ্রীষ্মের দুপুর। মাথার ওপর গনগনে সূর্য এবং প্রচন্ড গরম। গরমে অতিষ্ঠ গোপাল রাস্তার ধারে একটি বটগাছে বিশ্রাম নিতে বসল। গরম খুব বেশি অনুভূত হওয়ায় গোপাল তার গায়ের ফতুয়াটা খুলে পাশে রাখলো। খালি গায়ে গাছতলার ঠান্ডা বাতাসে বসে বিশ্রাম নিতে নিতে সে নিজের অজান্তেই ঘুমিয়ে পড়েছে।
ঘুম ভাঙতেই গোপাল দেখে, পাশে মেলে রাখা তার ফতুয়াটা নেই। চুরি হয়ে গেছে। গোপাল পড়ল বিপদে।এখন কি করা যায়? শ্বশুরবাড়িতে তো জামাই খালি গায়ে যেতে পারে না। চিন্তিত গোপাল মনে মনে প্রার্থনা করতে লাগল, হে ভগবান। রাস্তায় যদি আচমকা ২০ পয়সা কুড়িয়ে পাই, তাহলে দশ পয়সায় আমার জন্য একটা ভালো জামা কিনতে পারি। আর অবশিষ্ট ১০ পয়সা তোমার জন্য মন্দিরে দান করতে পারি।
কী আশ্চর্য! প্রার্থনা করতে না করতেই গোপাল কয়েকটি মুদ্রা রাস্তার ধারে পড়ে থাকতে দেখলো। গোপাল অত্যন্ত খুশী মনে পয়সাগুলো কুড়িয়ে নিল। গুনে দেখল ১০ পয়সা আছে মোট। গোপাল বলে উঠল, হে ভগবান, আমি তোমাকে বিশ্বাস করলাম ঠিকই। সাথে তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পারলে না! নিজের ভাগটা আগেই রেখে দিলে?
সরকারি চাকরি যারা করে তাদের অনেককেই বলতে শুনেছি, আমরা কেন আয়কর দিব? গোপাল ভাড়েঁর গল্পের ভগবানের মতো সরকার চাইলে নিজের অংশটা রেখে দিতে পারে নিজের কাছে।
একই কথা বলতে শুনেছি সরকারি বিভিন্ন প্রজেক্ট নিয়ে যারা কাজ করে, তাদেরকে। সরকারি প্রজেক্টের টাকা সরকারের ফান্ড থেকে আসে। সেই টাকা খরচ করার সময় কেন আবার ট্যাক্স দিতে হবে?
কিংবা একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য সরকারি প্রতিষ্ঠান যখন কোন কিছু কিনে, তখন কেন ভ্যাট ধরতে হবে? টাকা তো সরকারের একটা খাত থেকে আরেকটা খাতে যাচ্ছে। এভাবে সরকারের এক হাতের টাকা আরেক হাতে নিয়ে হাত বদল করে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে হিসেবটাকে জটিল করা দরকার কি?
এ ধরনের প্রশ্ন অনেক অভিজ্ঞ লোককে পর্যন্ত বলতে শুনেছি। এই ধরনের কথা যখনি শুনি, তখন আমার গোপাল ভাঁড়ের গল্পটার কথা মনে পড়ে যায়। তাদের ভাবখানা এমন, ভগবান তার অংশ নিজের কাছে রেখে দিলেই পারে।
আসলে বিষয়টা অর্থনীতির সাথে জড়িত। অর্থনীতিতে কোন একটি দেশের আয় হিসেব করা হয় তিনটি পদ্ধতি। তার মধ্যে অন্যতম হলো এক্সপেন্ডিচার মেথড। একটা দেশের সামগ্রিক আয় সেই দেশের সামগ্রিক ব্যয়ের সমান। সেটা নিয়ে আরেকদিন আলোচনা করবো। তাই কোন একটি দেশের মোট জাতীয় আয়ের হিসাব করার জন্য সেই দেশের মোট ব্যয় হিসাব করলেই হয়ে যায়।
কিন্তু মোট ব্যয় হিসাব করতে গেলে প্রতিটি পণ্যের মূল্যের সাথে ভ্যাট সংযোজন করতে হয়। কারণ ভ্যাট হল মূসক অর্থাৎ মূল্য সংযোজন কর। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড মূল্য সংযোজন কর হিসেব করার মাধ্যমে একটা দেশের মোট ব্যয় তথা মোট উৎপাদন হিসেব করে।
এই ব্যয়ের মধ্যে সরকারি ব্যয়ও সংযুক্ত হয়। যদি কোন দেশের সরকারি ব্যয়ের ক্ষেত্রে ভ্যাট তথা মূল্য সংযোজন কর যুক্ত করা না হয়, তাহলে তারা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের হিসাব থেকে বাদ পড়বে।
জাতীয় আয়ের হিসাব করার আরেকটি পদ্ধতি হলো ইনকাম মেথড। একটা দেশের সামগ্রিক আয় সেই দেশের সকল ব্যক্তি ও সকল প্রতিষ্ঠানের আয়ের সমষ্টির সমান।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড খুব সহজে আয়কর রিটার্ন এর মাধ্যমে আয়ের সমষ্টি হিসেব করতে পারে। কিন্তু যদি সরকারি কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে আয়কর বাদ দেয়া হতো তাহলে তাদের ইনকাম হিসেব করার জন্য আলাদা চার্ট মেন্টেন করতে হত। তখন বরং হিসেব আরো জটিল হয়ে যেত।
এভাবে ভ্যাট এবং আয়কর যদি সরকারি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে স্থগিত রাখা হতো, তখন ওই দেশের মোট জাতীয় আয়ের হিসাব করা কঠিন হয়ে যেতো। প্রকৃত হিসেব পাওয়া যেতো না।
এজন্যই আসলে এই ব্যবস্থা। যদিও আপাতদৃষ্টিতে এটাকে জটিল এবং অপ্রয়োজনীয় বলে মনে হয়, প্রকৃতপক্ষে এটি আসলে সহজীকরণের নিমিত্তে করা হয়েছে। এর ফলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড খুব দ্রুত এবং সহজে জাতীয় আয় সম্পর্কে আমাদেরকে একটি ধারণা দিতে পারে।
এছাড়াও যখন এই ধরনের ব্যয় সংযুক্ত হয়, তখন দেশের মোট জাতীয় আয় তথা জিডিপিও কিছু পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশ ও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে উন্নয়নের সূচক হিসেবে জিডিপি গ্রোথকে ফোকাস করা হয়। একটি দেশের জিডিপি বৃদ্ধি করতে এই আয়কর এবং ভ্যাট কিছুটা হলেও ভূমিকা রাখে।
অর্থনীতির বিষয়গুলো একটু নিরস। তার উপর আমাদের অনেকেরই অর্থনীতির বেসিক আইডিয়া নেই। ফলে অর্থনৈতিক বিষয়ক লেখা দেখলে আমরা এড়িয়ে যাই। সেজন্য আমি চেষ্টা করছি, অর্থনীতি বিষয়ক কিছু সরস আলোচনা করতে। গল্পের মাধ্যমে কোন কিছু বোঝালে সেটা দীর্ঘদিন মনে থাকে এবং সহজে আয়ত্ত করা যায়।
গোপাল ভাড়ের মজার মজার ঘটনাগুলো সমকালীন অর্থনীতির সাথে লিঙ্ক করে অর্থনীতির বেসিক কিছু আইডিয়া দেওয়াটাই আমার উদ্দেশ্য। সেই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে গোপালের অর্থশাস্ত্র ধারাবাহিকটি শুরু করেছি। আজ তার তৃতীয় পর্ব ছিল। আগের পর্বগুলি পড়তে পারেন নিচের লিংকে গিয়ে:
ঘুঁটা থিওরী এবং করোনা পরবর্তী দেশের অর্থনীতি
শেয়ার ব্যবসা এবং বেগুনের গুনাগুন
আত্মকথনঃ
আমি ত্বরিকুল ইসলাম। সখের বশে ব্লগিং করি। ব্লকচেইন এবং ক্রিপ্টোকারেন্সি বিষয়ে আগ্রহী।
- Hive: My Blog
- LeoFinance: My Leo
- Dtube: My Tube
- 3speak: My Vlog
- Twitter: My Tweet
- FB: My Profile
- Pinmapple: My Tour
- TravelFeed: My Feed
"পড়াশোনায় ইঞ্জিনিয়ার। পেশায় শিক্ষক। নেশায় লেখক। সাবেক ব্যাংকার। পছন্দ করি লিখতে, পড়তে, ভ্রমণ করতে এবং জমিয়ে আড্ডা দিতে।"
জীবনটাকে অনেক অনেক ভালোবাসি
Congratulations @tariqul.bibm! You have completed the following achievement on the Hive blockchain and have been rewarded with new badge(s) :
You can view your badges on your board and compare yourself to others in the Ranking
If you no longer want to receive notifications, reply to this comment with the word
STOP