কিশোর গল্প: কালো বিড়াল (৩য় পর্ব)
বাঁচার জন্য হাত পা ছোড়াছুড়ি করছে। শ্যাওলা পচা পানির তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ নাকে এসে লাগলো..
মধ্যবয়স্ক লোকটাকে দেখিয়ে রকিব উদ্দিন বললেনঃ ইনি তোমার রজব কাকা। আর উনি হলেন তোমার জহুরা কাকী। এই মিষ্টি সুন্দর ছেলেটা তোমার কাকাতো ভাই, জগলুল। ও তোমার সাথে খেলবে।
রিতীশ তাকালো। মিষ্টি সুন্দর ছেলে! সে দেখল তার চেয়ে বছর দুয়েকের ছোট একটা কুচকুচে কালো ছেলে- সারা গায়ে ময়লা- খালি পা দুটো ধুলোভর্তি- চুলগুলো উসকোখুসকো- আর তার দিকে তাকিয়ে ছেলেটা যখন হাসলো, হলদেটে দাঁতগুলো বেড়িয়ে আসলো। এই ছেলের সাথে সে খেলবে! অসম্ভব।
রজব উদ্দিন বললেনঃ যাও রিতীশ, জার্নি করে এসেছো। পুকুর থেকে গোসল করে ফ্রেশ হয়ে আসো। জগা, রিতীশকে পুকুরে নিয়ে যা।
রিতীশ অবাক হয়ে বললঃ গোসল করব পুকুরে! আপনাদের বাথটাব নেই?
এই কথায় বাবা, কাকা আর কাকী আবার হো হো করে হেসে উঠলেন। রিতীশ মন খারাপ করে ব্যাগ থেকে টাওয়েল ও ট্রাউজার বের করে জগলুলের সাথে পুকুরের দিকে রওনা দিলো।
পাতা পচে পানি থেকে একটা বিশ্রী গন্ধ ভেসে আসছে..
ভেতর বাড়িতে একটা ছোট্ট উঠোন। উঠোন পার হলেই পুকুর। পুকুরটার চারিপাশ গাছে ছেয়ে আছে। পুকুর পারের গাছ গুলো ঢালু হয়ে পানির দিকে ঝুঁকে তারপর উপরে উঠে গেছে। যার ফলে এই শীতে গাছগুলোর বেশিরভাগ পাতা ঝড়ে পুকুরের পানিতে ভাসছে। পাতা পচে পানি থেকে একটা বিশ্রী গন্ধ ভেসে আসছে। এই নোংরা ঘোলা দুর্গন্ধযুক্ত পানিতে ওরা কিভাবে যে গোসল করে, ভাবতে গা গুলিয়ে আসে। রিতীশ ঠিক করলো, এই পানিতে সে কিছুতেই গোসল করবে না। ঘাটে নেমে হাত মুখ ধুবে শুধু।
ঘাটের পাশে একটা চিকন বাশের কঞ্চি ঝোলানো আছে, সেটাতে টাওয়েল ট্রাউজার রেখে ঘাটে সোজা হয়ে দাঁড়ালো রিতীশ। সামনে ঝুঁকে পানি স্পর্শ করতে যাবে, এমন সময় সে কল্পনায়ও ভাবতে পারে নি এমন একটা ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে গেল।
তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পেছন থেকে জগা ছুটে এসে দুই হাতে ধাক্কা মারলো, এত জোরে মারলো যে রিতীশ ছিটকে পরে গেল পানিতে। কয়েক হাত দূরে গিয়ে পরলো, ফলে তার পা মাটি খুঁজে পেল না। সে ধীরে ধীরে ডুবে যেতে থাকল। বাঁচার জন্য হাত পা ছোড়াছুড়ি করছে। শ্যাওলা পচা পানির তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ নাকে এসে লাগলো।
সে চিৎকার করতে যাবে, মুখ খুলতেই নোংরা পানিগুলো হুরমুর করে মুখের ভেতর ঢুকে গেল। শ্বাস নিতে গিয়ে কিছু পানি নাকের ভিতর দিয়ে ঢুকে মনে হল মগজ পর্যন্ত চলে গেছে। ভেতরে প্রচন্ড জ্বলছে। একসময় সে পানিতে ভেসে থাকা শ্যাওলা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। চোখও জ্বালা করছে। সে শুনতে পেল পুকুর পার থেকে জগা হাততালি দিয়ে চিৎকার করে মজা করছেঃ ভাইজান সাঁতার পারে না... হা হাহ হা...
মানুষের মৃত্যু যে কোন হাসি ঠাট্টার বিষয় নয়, এটা জগাকে বোঝানোর মত কেউ কি এই গ্রামে ছিল না?
অক্সিজেনের অভাবে স্নায়ু অসার হয়ে আসছে..
এখন এই গেঁয়ো ছেলেটার নির্বুদ্ধিতায় প্রান হারানোর আগ মুহূর্তে রিতীশের সব রাগ গিয়ে পরলো তার বাবার উপর। কেন তিনি একগুঁয়েমি করে তাকে গ্রামে নিয়ে আসলেন? সে মারা গেলে তার মার্ভেল সিরিজের স্টিকারগুলো- যেগুলো সে একটা একটা করে জমিয়েছে- সযত্নে লুকিয়ে রেখেছে চিলেকোঠার গোপন কুঠুরীতে- সেগুলো কেউ আর কোন দিন খুঁজে পাবে না।
অক্সিজেনের অভাবে স্নায়ু অসার হয়ে আসছে। শরীর নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে। হাত পা ছোড়াছুড়ি বন্ধ হয়ে গেছে। মৃত্যু ধীরে ধীরে গ্রাস করে নিচ্ছে। রিতীশ যেন বহুদূরে পানিতে কিছু একটা পড়ার শব্দ শুনতে পেল।
জগা হাফপেন্টটা খুলে ঝাঁপিয়ে পড়েছে পানিতে। বেশি দূরে নয়। ঘাটলা থেকে মাত্র তিন হাত দুরত্ব হবে। একটু হাত বাড়িয়ে দুইবার জল কাটলেই ঘাটলাটা নাগালে পেত, কিন্তু শহরের ছেলে বলেই কিনা হাত পা এলোপাথারি ছুঁড়ে ঘাট থেকে আরও দূরে সরে গেছে।
জগা একহাতে রিতীশের জামাটা টেনে ধরে অন্য হাতে জল কাটতে কাটতে ঘাটে এসে রিতীশের মাথাটা উচু করে ধরল। ভেতরে বাতাস গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। কয়েকটা বড় বড় শ্বাস নিয়ে তারপর রিতীশের পা দুটো কাঁধের দুইপাশে ঝুলিয়ে দিয়ে হাত আর ঘাড়ে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে একটা ধাক্কা মারলো- তাতে রিতীশের ভেজা দেহটা জল থেকে ঘাটলার পাকা পাটাতনের উপর উঠে গেল।
জগা হাফপেন্টটা খুলে ঝাঁপিয়ে পড়েছে পানিতে..
জগা রীতিমত হাপাচ্ছে। রিতীশের দেহ ধরে কয়েকবার নাড়া দিল। কোন সারা শব্দ নেই। মরে টরে গেল নাকি? ভয়ে আতঙ্কে জগার মুখখানা এতটুকু হয়ে গেল। সে চিৎকার দিলোঃ আব্বা, আম্মা। রিতু ভাই কথা কয় না...
চিৎকার শুনে ভেতরবাড়ি থেকে সবাই ছুটে এল।
(চলবে..)
আগের পর্ব গুলো নিচের লিংক থেকে পড়তে পারেন..
(১ম পর্ব)
(২য় পর্ব)
Congratulations @tasri! You have completed the following achievement on the Hive blockchain and have been rewarded with new badge(s) :
You can view your badges on your board and compare yourself to others in the Ranking
If you no longer want to receive notifications, reply to this comment with the word
STOP