24 april 2013 রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি।

24 april 2013
৯.১৫ নাগাদ ঘুম থেকে উঠি আমি। আম্মা বলেন ডিম ভেজে ভাত খেয়ে নাস্তা করে নিতে।পেয়াজ কাটতে বসেছি কেবল,হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠলো।এতো সকাল আবার কে!
দরজা খোলা মাত্র ৪তলার চাচি প্রশ্ন ছুড়লেন,
তোমার বাবা বাসায় আছে?
আমি বললাম না তো! বাবা তো অনেক আগেই অফিসে চলে গেছে।
চাচি এবার আমাকে ঠেলে সোজা ভেতরে চলে গেলেন সরাসরি আম্মার কাছে!
বললেন, আপা! রানা প্লাজা তো ধইসা পরসে!
আম্মা হঠাৎ চুপ করে বুঝতে চেষ্টা করলেন,
বললেন!
মানে? কি বলেন আপনি? ধইসা পরসে মানে? মানে কি?
আমি বুঝলাম না কিছুই।রানা প্লাজা! এতো বড় একটা বিল্ডিং! তা আবার ধসে কেমনে?
চাচি আমাদের কথার পরোয়া না করে বললেন,
আপনি চলেন! তাড়াতাড়ি চলেন আমি নিয়া যাবো আপনারে। received_395108655189435.jpeg
Source

সবকিছু তখনো আমার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছিলো। যাবেই তো পড়তাম তখন ক্লাস ফাইভে! জিবনের খুব কম বাস্তবতাই আমার দেখা।বলতে গেলে দেখিইনি। আমি আমার জামা আনতে বারান্দায় গেলাম।বাইরের দিকে চোখ গেলো দেখলাম শত শত মানুষ বাস স্ট্যান্ড এর দিকে ছুটে যাচ্ছে! আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে এলো! এমন দৃশ্য আগে তো দেখিনি!
মা বোরখা পড়লেন। মা কে উদভ্রান্ত দেখালো! বাবাকে এতক্ষনে হাজার বার ফোন করা হয়ে গেছে! ধরেনি কেউ। চাচি হঠাৎ হ্যালো বলে উঠলো
হ্যালো হ্যালো মিজান ভাই! আপনি কোথায় আছেন? আপনি কোথায়?
চাচি আর কিচ্ছু বললেন না কি যেন শুনে গেলেন। ফোনের অপর প্রান্তে কে আছে কি বলছে তার কিছুই আমরা জানিনা। মা চাচির পায়ে পরলেন।বললেন,
আপা একবার বলেন আমার স্বামী বেঁচে আছে! আমার আর কিচ্ছু দরকার নাই!
চাচি কিচ্ছু বললেন না।দুচোখ তার রক্তিম লাল। আমার ছোট বোন কে চাচির ঘরে রেখে আমরা বেরিয়ে গেলাম।ছয় মাসের অন্তসত্তা মা আমার। কাঁদতে কাঁদতে পাগলের মতো রাস্তা দিয়ে দৌড়াতে লাগলেন।পায়ে তার জুতা নেই! আমার নিজের পায়েও নেই। রাস্তায় বারবার চাচিকে অনুনয় বিনয় করেন,
আমারে সান্ত্বনার ছলেই বলেন, আমার স্বামী বেচে আছে! আপনাকে হ্যালো বলসে সে? সে আপনার সাথে কথা বলসে?
চাচি বললেন, মিজান ভাই এর বন্ধু ফোন ধরেছিল।
আম্মা জোরে জোরে কালেমা পড়েন।দোয়া ইউনুস বলেন
আল্লাহ রে! আমার পেটের সন্তানের উসিলায় তুমি তারে আমার কাছে ফিরায় দাও।

আমরা রানা প্লাজার সামনে গিয়ে পৌছালাম। বাবার সাথে কতবার এসেছিলাম! ৯তলা ভবন টার কিচ্ছু নাই! মাটির বুকে বিলীন। আশেপাশের মানুষের হাহাকার শোনা যায়! কেউ বাঁইচা নাই ভিতরে কেউ বাঁইচা নাই!
আমি দুহাত দিয়ে আমার মায়ের কান চেপে ধরি।
আমার বাবার অফিস ছিলো চার আর পাঁচ তলা জুড়ে।
আমরা আশেপাশের সব হসপিটালে খোঁজ করতে থাকি। বাবার ফোন এবার বন্ধ। বুকের সাহস ফুরানোর পথে।আমার মাকে ধৈর্য্যহারা দেখালো না। হঠাৎ অচেনা নম্বর থেকে ফোন আসে! !)

ধরতেই শুনি মোশাররফ চাচার কান্নাজড়িত কন্ঠ,
তোমার বাবা সুপার হাসপাতালে আছে।
অজানা আশংকায় মৃত্যু যন্ত্রণা একবার ছুয়ে যায় আমাকে। দ্রুত হাসপাতালে পৌছে যাই। দেখি বাবা হাসপাতালের একটি কাউচে শুয়ে আছে।মাথায় ব্যান্ডেজ পায়ে প্লাস্টার, আর পিঠে সরু লম্বা ঘন খোয়েরি একটা দাগ। মা বাবার বুকের দিকে ঝুকে কাঁদতে থাকেন। আমি বাবার গালে আমার একটা হাত রাখি,
বাবা চোখ খোলেন।বলেন,
-মণি! ছোটন কই?
আমাকে বাবা আদর করে মণি ডাকেন।আর আমার ছোট বোনকে ছোটন।
আমি কিচ্ছু বলিনা। শুধু ডুকরে কেঁদে উঠি।মোশাররফ চাচা আমাকে কাছে টানলেন,
পাগলি মেয়ে কাদেনা! দেখো তোমার বাবা ঠিক আছেন।
হাসপাতালের ফ্লোর এও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিদ্ধস্থ মানুষ।একের পর এক আহত আসতে থাকে। কারো পেট ফুড়ে রক্ত বেরিয়ে একাকার। কারো কপাল গড়িয়ে রক্তের জোয়ার।কেউ বা হারিয়েছে অংগ! received_367628644347400.jpeg

Source

আহ কি বিভৎস! কি নির্মম সে দৃশ্য!

আমার মাথা ঘুরিয়ে ওঠে৷ মোশাররফ চাচা নিজের দুহাত দিয়ে আমার দুচোখ ঢাকেন।
ডাক্তার জানান বাবা কে আমরা বাড়ি নিতে পারবো।কিন্তু সরকারি কিসব পরিসংখ্যান এর জন্য থাকতে হবে। বাবা কেঁদে উঠলেন।হাসপাতালের দৃশ্য সহ্য করা কোনো স্বাভাবিক মানুষের জন্য নিতান্তই কঠিন।তাই বাবা কে আমরা বাড়ি নিয়ে আসি।বাড়ি জুড়ে হই হুল্লোড় সৃষ্টি হয়। বাবা কে দেখতে আসে সারা এলাকার মানুষ। একের পর এক ফোন আসতে থাকে।যারা কখনো আমাদের খবর নেয়নি তাদেরও কান্নারত কণ্ঠ শুনতে পাই।আমিও কাঁদি।কাঁদতে কাঁদতে স্বান্তনা দেই।
কিচ্ছু হয়নি বাবার আপনারা চিন্তা করবেন না।আমার বাবা ভালো আছেন।
কিন্তু বাবার কান্না থামেনা। মা বাবার বুকের উপর ঝুকে জিগেস করেন,
কি লাগবে আপনার? কি খাবেন? কষ্ট হইতাসে? কোথায় কষ্ট হয় আমারে বলেন!
বাবা আরো জোরে কাঁদেন! বলেন,
আমার সব শেষ হইয়া গেলো! আমার সবগুলা আপনজন হারায়া গেলো! আমি সব হারায় ফেলসি! আমি ক্যান ফিরা আসলাম আমি কেমনে বাঁচবো এতো মানুষ হারানোর যন্ত্রণা নিয়া!
মা কিচ্ছু বলেন না চোখ থেকে অনবরত পানি বিসর্জন যায়।
বাবা কে জোর করে খাওয়ান মা। বাবার কান্না থামেনা তখনো। অনবরত ফোন আসতে থাকে৷ প্রত্যেক মিনিটে! আসে মৃত্যুর খবর! আসে আপনজনের লাশ পাওয়ার খবর! আপনজন! রক্তের সম্পর্ক নয়! হৃদয়ের সম্পর্ক! প্রত্যেক বার বাবার কান্নার গতি বাড়ে৷ আমি বাবা কে জিগেস করি এবার কার কথা শুনসো বাবা?
বাবা আরো কাঁদেন বলেন,
ইডি স্যারের লাশ পাওয়া গেসে!
আমি চিনতান। সেই প্রত্যেকটা মানুষকে। এই ২/৩ মাস আগেই তো বাবার অফিসের পিকনিকে গেলাম । সবাই কতো ভালোবাসলো। মা প্র্যাগনেন্ট বলে যেতে পারেনি। যারা এতো ভালোবাসলো। এতো আদর করলো। তারা নাকি নেই! কি করে সম্ভব?
টিভি দেখে মানসিক রোগীতে পরিণত হওয়ার যোগার! যাদের লাশ পায় তাদের প্রায় অনেকজন কে আমি চিনি! এভাবে এখবর টিভি তে দেখবো! এতো বড় ধ্বংস লীলা আমার জীবনে ঘটবে! কখনও তো ভাবিনি!
বড় আব্বু এলেন গ্রাম থেকে।সে কি কান্না তার! বাবা নিজের কান্না থামায়ে বলতে লাগলেন,
আমি সকাল থেকে অসুস্থ বোধ করতেসিলাম। প্রেশার মাপাইলাম নার্স এর হাতে ৪ তলায়! তারপর নিচতলায় গেলাম মাল রিসিভ এর কাজে ওমনি হন্তদন্ত হয়ে রহিম আসলো! বলল!
স্যার বিল্ডিং তো পইরা যাইতাসে! বাইর হন স্যার বাইর হন।
বলেই সে সিড়ির দিকে গেলো! সাথে সাথে দেখলাম সম্পূর্ণ সিড়িটা তার গায়ের উপর ভাইঙা পড়লো! ১/২ মিনিটের মধ্যে নয় তলার এই পুরা ভবন টা বিকট শব্দ কইরা ধইসা পড়লো! আজ আমি আন্ডারগ্রাউন্ড এ না থাকলে কোনোদিনও ফিরতাম না! আল্লাহ আমারে নামাইসে! আল্লাহ আমার হায়াত রাখসে! আল্লাহ আমার মানুষগুলার হায়াত রাখেনাই রে ভাই।

সন্ধায় খবরে দেখলাম সেই নার্স এর ও লাশ পাওয়া গেছে।বাবাকে বললাম না।
প্রতিদিন ই আপন মানুষের মৃত্যুর খবর পেতে পেতে জীবন টা দূর্বিষহ হয়ে উঠতে লাগলো।আস্তে আস্তে দারিদ্রতা ছুয়ে যাচ্ছিলো আমাদের। আত্মীয় স্বজনরা পাড়া প্রতিবেশী রা অনেক সাহায্য করে!এখানে কেউ নেই আমাদের। সবাই গ্রামে! মা গর্ভবতী! বাবা বেকার! হাটতেও পারেন না! পা ভেঙে আছে। সম্পূর্ণ পরিবারের দেখাশুনার ভার এসে পড়লো আমার উপর। আমি! পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। স্বল্প টাকা হাতে নিয়ে ছুটি বাজারের উদ্দেশ্যে। মাকে ডাক্তার দেখানো! বাবাকে স্টেচারে ভর করিয়ে হাটানোর চেষ্টা। ছোট বোন কে দেখে রাখা! এতটুকু বয়সে জীবনের করুণ বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে আমার বয়স যেন কয়েকশ বছর বেড়ে গিয়েছিলো।

এখন ২০২০ সাল। অতিবাহিত হয়েছে ৭ টি বছর।তবুও প্রতিবছর এ দিন টা কাঁদায় আমাদের প্রত্যেককে।বাবা কে ফিরে পেয়েছি রব্বুল আলামীনের কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া। কিন্তু হারিয়েছি আরো অনেক মা বাবা কে। শুধু রয়ে গেছে স্মৃতি।received_773090283537961.jpeg

Source

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি! বিভৎস সেই রাত গুলো! ঘুমোতে যে পারিনি! পারবেনা ফিরিয়ে দিতে।পারবেনা ফেরাতে মায়ের বুকে সন্তান কে যে মা সন্তানের কপালে চুমো একে বলেছিলো দোয়া পড়ে গাড়িতে উঠবি কিন্তু! রাস্তার দুদিক দেখে পার হবি! অভার ব্রীজ দিয়ে পার হবি! সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য বেশি!
পারবে কি ফেরাতে সন্তানের কাছে বাবাকে? যে সন্তান হয়তোবা সেদিনটা বাবার সাথে স্কুলে যাওয়ার বায়না করেছিলো! কিন্তু বাবার সময় কই? তাকে তো অফিসে যেতে হতো!
পারবেনা ফেরাতে স্ত্রী এর কাছে স্বামীকে। যে স্ত্রী অন্তস্বত্তা। হয়তোবা অনেক বছরের সাধনার পর সন্তানের মুখ দেখতে চলেছে? হয়তোবা সে তার স্বামীকে সুখবর টা ফিরলে জানাবে ভেবেছিলো?

পারবেনা ফেরাতে সন্তানের কাছে মাকে। যে সন্তানের আহার শুধুমাত্র তার মায়ের বুকের দুধ!

শুধু সেসব মানুষের লাশ হলেও ফিরিয়ে দাও যেসব মানুষের লাশগুলোর সন্ধান পেতে বিদ্ধস্ত তোমার সামনে দাঁড়িয়ে ছবি হাতে কেঁদেছিলো স্বজনরা,অন্তত লাশ!

আহা! রানা প্লাজা! তুমি সবাইকে সংগে নিয়ে অতল গহীনে হারিয়ে গেলে! কাওকেই বুঝি ফেরাতে পারবেনা!

সত্য ঘটনা অবলম্বনে....

সমাপ্ত .....

Pictures are taken from Facebook random pictures.



0
0
0.000
8 comments
avatar

Congratulations @troublemakerrr! You have completed the following achievement on the Hive blockchain and have been rewarded with new badge(s) :

You received more than 900 upvotes. Your next target is to reach 1000 upvotes.

You can view your badges on your board and compare yourself to others in the Ranking
If you no longer want to receive notifications, reply to this comment with the word STOP

Do not miss the last post from @hivebuzz:

Feedback from the November 1st Hive Power Up Day
0
0
0.000
avatar

সময়টা খুবই কষ্টের ছিল। নিউজে দেখেই চোখে পানি চলে আসছিল। বলতে গেলে খুবই ভয়ানক একটা সময় কাটছিল ওখানকার মানুষের। আল্লাহ যাতে এমন ভয়ানক কোন কিছু আর না দেখান। হেফাজতে রাখুক সবাইকে

0
0
0.000
avatar

আমি সবটা নিজের চোখে দেখেছি। হাহাকার শুনেছি নিজের কানে। আল্লাহ তাদের ভালো করুক। ধন্যবাদ সময় নিয়ে পড়ার জন্ন্যে।

0
0
0.000
avatar

onekdin agey ghotey jawa ghotona eta.
vulei giyechilam.

kichudin agey hothat kothay jeno ei pic tai dekhte pai...

received_395108655189435.jpeg
Source

abar mone pore jay... r tokhon vebechilam j kichu jinish vuley thakai better.
abar mone koriye dilen akhon.
jara mara giyechhilo ei tragedy te tader atta shanti pak ei dowai kori.

0
0
0.000
avatar

আমিও ভুলে যেতে চাই। তবে পারিনা, সামনে থেকে দেখেছিতো। ধন্যবাদ সময় নিয়ে পড়ার জন্য।

0
0
0.000
avatar
(Edited)

samne theke dekhechilen?
hmm tahole bisoy ta onnorokom.
ami tokhon kebol high school e chilam r elakar bahire tamon 1ta jawa hoto na tai kachakachi thaka sotteo oidik tatey jawa hoy ni.
tobey motamuti onekkichui e jana chilo about the tragedy.
dhonnobad sundor 1ta article tuley dhorar jonno.

0
0
0.000
avatar

হুম কাছে থাকে দেখেছি । এখনো হাহাকার মনে পড়ে। আপনাকেও ধন্যবাদ সময় নিয়ে পড়ার জন্য। আশা করি সামনে ভালো কিছু লিখতে পারবো। আপনার জন্য শুভ কামনা রইল।

0
0
0.000