রক্তের নয় হৃদয়ের সম্পর্ক ছিল তাদের।
মতি পুরো বাড়ি সাফাই করে বাড়ির দরজায় বসে রইলো।করিম সাহেবের আসতে দেরী হবে সে জানে। তবুও কাজ শেষ করে দরজায় বসে থাকে অপেক্ষায়।যতক্ষন না করিম সাহেব আসেন ততোক্ষণই সে বসে থাকে।এই বিশাল এক বাড়িতে করিম সাহেব আর মতি দুজনে মিলে থাকে।করিম সাহেবের স্ত্রী মরেছেন বছর তিনেক আগে। ছেলে মেয়ে তার তিনজন।তিনজনই বিদেশে ওয়েল সেটেল্ড। বাবার খোঁজ খবর রাখেনা খুব একটা। সম্পদের প্রয়োজনেও না। কারন তারা যথেষ্ট ভালভাবে মানুষ হয়ে ভালো অবস্থানেই আছে। আর যার অক্লান্ত পরিশ্রমে সে অবস্থানে পৌঁছালো তার খবর রাখার কোনো কারন সম্ভবত তারা খুজে পায়না।হয়তো সময় হয়না। সে যাই হোক!
করিম সাহেব ফিরলেন ১০ টায়।না কোনো কাজে তিনি যাননি। বেকার বৃদ্ধ গিয়েছিলেন চা দোকানে বসে তারই মতো কিছু বেকার বৃদ্ধের সাথে দেশ বিদেশের বড় বড় রাজনৈতিক আলোচনা সারতে।বড় বড় সিদ্ধান্ত নিতে।যদিও সেগুলো শুধুমাত্র চা দোকান পর্যন্তই সীমাবদ্ধ!কিন্তু তবুও আলোচনায় মুখ্য ভূমিকা তো রাখতেই হয়! সিনিয়র সিটিজেন বলে কথা!
মতি করিম সাহেবকে দেখে মুখ বাঁকালো। বলল,
আহারই তো দরকার আসিলো না!
করিম সাহেব জুতো খুলতে খুলতে চশমার উপর দিয়ে মতির দিকে একবার তাকালেন।তারপর বললেন, জানিস মাঝে মাঝে কি মনে হয়?
মতি বলল, জানিনা! কইলে জানুম।
করিম সাহেবের উত্তর, থাক জানতে হবে না!যা তরকারি গরম কর গিয়ে। মতি এবার ভিষণ বিরক্ত হলো! ভাবে বলবেন না যখন আগ্রহ জাগালেন কেন? ধুর!
খেতে বসে করিম সাহেব জিগেস করলেন, মতি ঘুরতে যাবি?
মতি বেশ আগ্রহ পেলো, ঘুরতে? কোথায়?
করিম সাহেব বললেন, রেধে নিবি সকাল সকাল। সব নিয়ে রউনা হবো। যেদিক দুচোখ যায় সেদিকেই যাবো, মাঝে বিরতি নিয়ে কোনো এক নদীপারে দুপুরের খাবার টা সেরে নেবো।
মতির চোখ দুটো চকচক করে উঠলো। বোঝা গেলো বেশ খুশি হয়েছে সে।কিন্তু মুখে তা প্রকাশ করলো না।উল্টো বলল, এতো ঘুরাঘুরি আমার ভাল্লাগেনা। আপনেই যান আপনারেই সয়।
করিম সাহেব এবার মতির পিঠে বড় করে একটা কিল বসিয়ে দিলেন।
মতি ওমাগো বলে তার ব্যাথার জানান দিলো।
করিম সাহেব বললেন, সকালে যদি উঠে দেখি তুই আমার আগেই তৈরি তাহলে তোর খবর আছে!
পরদিন সকালে ঠিক তাই হলো যা করিম সাহেব ভেবেছিলেন।মতি আগেভাগেই রান্না বান্না সেরে তৈরি হয়ে আছে। করিম সাহেব দেখে মুচকি হাসলেন। রওনা হলেন দুজনে।খাবারের গাট্টি নিয়ে হাটা ধরলেন করিম সাহেব আর সাথে মতি ।মতি বেশ কতদূর হাটার পর ভিষণ বিরক্ত হয়ে বলল, আর কতক্ষণ হাটুম? বাসে যাইতাম!
করিম সাহেব পান চাবাতে চাবাতে বললেন,
তোকে না বলেছিলাম যেদিকে দুচোখ যাবে সেদিকে যাবো! বাসে মানুষ তখনই ওঠে যখন তার কোনো গন্তব্য থাকে।আমাদের আছে?
মতি প্রশ্নের উত্তর দিলো না। মুখ বাকিয়ে আরো জোর গতিতে হাটলো তারপর হঠাৎ দৌড় দিলো।হঠাৎই হাপিয়ে উঠে একটু থামলো। করিম সাহেব মতির কান্ড দেখছিলেন।মনে হচ্ছিলো যেন এভাবে গেলে পথ টা বুঝি দ্রুত শেষ হয়ে যাবে।করিম সাহেব আগের গতিতেই হাটতে থাকেন।হাটতে হাটতে করিম সাহেব এক ঘাট পারে এসে মায়মুনা বেগমের কবরের সামনে থামলেন।মতি এখনো অনেক পেছনে। তার অযৌক্তিক পন্থা অবলম্বন করতে করতে সে এতোটাই ক্লান্ত হয়েছে যে এখন ধির গতিতেও হাটতে হিমশিম খাচ্ছে। করিম সাহেব পেছন ফিরে মতির দূরত্ব দেখলেন। মনে মনে হিসেব কষলেন।মতির এই পর্যন্ত আসতে ঠিক ১মিনিট ২০সেকেন্ড সময় লাগবে।আর যদি সে তাড়াতাড়ি আসে তাহলে ২০ সেকেন্ড। কিন্তু তা সম্ভব নয়। কারন মতির শক্তিই নেই। সে হেলে দুলে আস্তে ধিরেই আসবে। করিম সাহেব ঘড়ি দেখে হিসেব করতে লাগলেন।কিন্তু তার হিসেব হলো ভুল।মতি আস্তে আস্তে আসলো ঠিকি।কিন্তু সময় লাগলো ৫৭ সেকেন্ড। করিম সাহেব হতাশ হলেন। মতি আসার পর দুজনে মিলে মায়মুনা বেগমের জন্য মোনাজাতে দোয়া করলেন। দোয়া শেষে করিম সাহেব বললেন,
শোন মতি আমি যদি মারা যাই তাহলে আমাকে কিন্তু তোর দাদীর ডানপাশে কবর দিবি।আমি তোকে বলে গেলাম কারন আমার তুই ছাড়া কেউ নেই।এটাই কিন্তু আমার শেষ ইচ্ছা।
মতি তার হলুদ দাঁতগুলো বের করে হাসি দিলো।
বলল,
আপনের আগে আমিই মরুম দাদা। আপনার আমি ছাড়াও আরো অনেক মানুষ আসে আমার আপনি ছাড়া জীবিত আর কেউই নাই।আরেকজন আসে আমার দাদী! কিন্তু সে তো মইরা ভূত! এই দাদীর বামপাশটায় আমারে কবর দিবেন দাদা। এইডা আমার শেষ ইচ্ছা!
করিম সাহেব ব্যাথিত হলেন। কিন্তু মতিকে বুঝতে না দিয়ে উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন।বললেন, থাম ছোকরা! ইচ্ছার আবার শেষ আছে নাকি? তুই না শহর দেখতে চেয়েছিলি? দেখবিনা? দেখাবো তো।দেখার আগে মরবিনা কিন্তু খবরদার!
মতিও হাসলো এবার। দুজনে হাত ধরে ঘাট পারে গেলো।মাদুর বিছালেন করিম সাহেব। দুজনে মিলে খোশগল্প করতে করতে খেলেন। খাওয়া শেষে মতি সারা ঘাটে দৌড়ে দৌড়ে খেলতে লাগলো।মতিন সাহেব মাদুরে বসে সেদিকটাই তাকিয়ে রইলেন।
মতি ঠিকই বলেছে।হয়তো করিম সাহেবের আগে সব মায়া ত্যাগ করে সে ই চলে যাবে।মতি ক্যান্সারে আক্রান্ত।ডাক্তারের ভাষ্যমতে সে এই পৃথিবী তে বড়জোর আর ২/৩ মাস আছে। ৪ বছর আগে মায়মুনা বেগম বেঁচে থাকতে মতিকে বাড়ি নিয়ে আসেন নিজের বাপের বাড়ি থেকে।করিম সাহেব জিগেস করেন,
কোথায় পেয়েছো ওকে?
মায়মুনা বেগম বলেন, এতিম ছেলে।বিধবা খালার বাড়িতে ছিলো সে।আমাদের এলাকাতেই। খালা মারা গেছেন আজ।অসুস্থ ছেলে টা যাবে কোথায়?
অসুস্থ? করিম সাহেব প্রশ্ন করেন।
মায়মুনা বলেন ওর পেটে টিউমার। চিকিৎসার অভাবে বড় হচ্ছে দিন দিন।আমাদের তো সহায় সম্পদ আল্লাহ দিয়েছেনই! ওকে আমরা দেখে রাখতে পারিনা?
করিম সাহেব একটুও অমত করেন না।তিনি ছেলে টা কে কাছে টেনে নেন। নিজের নাতি নাতনিকে তো কাছে পান না।মতিকে পেয়ে স্বর্গসুখ পান।কিন্তু হায়! সুখ স্থায়ি হলো কই? মতির পেট থেকে অপারেশন করে টিউমার অপসারণ করা হলো। মায়মুনা বেগম আর করিম সাহেব তাকে ভালোবেসে বড় করছিলেন।দুখের ছায়াও মারাতে দিচ্ছিলেন না। কয়েক মাস পর মায়মুনা বেগম মারা গেলেন। মতি যেন তার মাকে হারালো! সেদিন রাতেই মতির অসহ্য পেটে ব্যাথা।তাকে হাসপাতালে নিলেন করিম সাহেব। জানা গেলো! মতির পেটে আবারো টিউমার যা ক্যান্সারের রূপ নিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। করিম সাহেব হাসপাতালেই বেহুশ হলেন। একই দিনে বুঝি সব হারালেন।
মতির অনেক চিকিৎসা করানো হলো।কিন্তু একসময় ডাক্তার করিম সাহেব কে বললেন,মানসিক ভাবে প্রস্তুত থাকতে। মতি তার অসুখ সম্পর্কে জানে।ছেলেটার অনেক ধৈর্য্য।একটুও ভেংগে পড়েনা সে। ওর থেকে শক্তি পান করিম সাহেব।
করিম সাহেবের ভাবনাচ্ছেদ হলো মতির চিৎকারে। করিম সাহেব দূর থেকে দেখলেন মতি পড়ে গেছে। দৌঁড়ে গেলেন তিনি।মতিকে ওঠালেন।সারা শরির গা হাত পা মুখে তার কাদা মেখে গেছে।করিম সাহেব হো হো করে হেসে উঠলেন।রেগে গিয়ে মতি বাড়ির দিকে হাঁটা ধরলো।করিম সাহেবও হাসতে হাসতে সব গুছিয়ে নিয়ে ওর পেছন পেছন রওনা দিলেন।
পরের মাসে মতির শরিরের অবস্থা খারাপের দিকে গেলো।এতোদিন বেশ চাংগা ছিলো সে।মানা করলেও বাড়ির কাজগুলো সব করতো।আর এখন রাত বিরেতে চিৎকার করে কাঁদে ।করিম সাহেব মুখ শক্ত হয়ে বসে থাকেন। কাঁন্না টা তার কোথায় যেন আটকে থাকে। কিচ্ছু করার নেই।জীবিত এই মানুষ টা মরতে চলেছে আর তিনি জেনেও কিছু করতে পারেন না। প্রকৃতির নিয়ম। আল্লাহর ইচ্ছা।
তার ঠিক তেরো দিন পর মতি মারা গেলো।ছোট্ট ছেলে টা। বয়স ছিলো মাত্র ১৪!করিম সাহেবের শেষ অবলম্বন টুকুও হারিয়ে গেলো।মতির শেষ ইচ্ছা মোতাবেক তাকে মায়মুনা বেগমের কবরের বামপাশটায় কবর দেওয়া হলো।
করিম সাহেব মতির কবরের সামনে হাটু ভেংগে বসে বাচ্চাদের মতো কেঁদে ফেলেন,
তুই যে চলি গেলি মতি! আমার শেষ ইচ্ছা তবে কে পূরণ করবে রে!
তার ই ডানে শায়িত মায়মুনা বেগমের উদ্দেশ্যে বললেন,
তোমার শেষ ইচ্ছা ছিলো আমি যাতে ওর সব ইচ্ছাই পূরণ করি।আমি পারিনি! আমি দুঃখিত! শহর ঘুরিয়ে ওকে দেখাতে পারিনি! তার আগেই ও চলে গেলো! কিন্তু জানো তো, এই অসুস্থ ছেলে
টা আমার এতোটা খেয়াল রাখতো যে মাঝে মাঝে মনে হতো, তোমার আত্মা বুঝি ওর উপর ভর করেছে! ভেবে হাসতাম খুব!
কথাগুলো বলে করিম সাহেব বেশ কিছুক্ষন চুপ করে থাকেন।যেন উত্তর দেবে কেউ স্বান্ত্বনার স্বরে! কিন্তু কেউ নেই করিম সাহেবের আশেপাশে।নিজের কান্না থামিয়ে তিনি বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে পা বাড়ান। পথিমধ্যে নিজেই নিজেকে বলেন,
"যার কেউ নেই তার আল্লাহ আছেন।আল্লাহ যাকে অনেক ভালোবাসেন তার সব কেড়ে নিয়ে তার পরীক্ষা নেন।যে ধৈর্যধারী জয় শুধুমাত্র তার।"
Congratulations @troublemakerrr! You have completed the following achievement on the Hive blockchain and have been rewarded with new badge(s) :
You can view your badges on your board and compare yourself to others in the Ranking
If you no longer want to receive notifications, reply to this comment with the word
STOP
Do not miss the last post from @hivebuzz: